ব্রেকিং:
আরজি কর মেডিকেলে ২০০ কোটির দুরনীতি, একাধিক প্রভাবশালীর জোগ থাকার সম্ভাবনা নলপুরে বেলাইন সেকান্দ্রাবাদ-শালিমার এক্সপ্রেস চলতি মাসেই ২০ ডিগ্রির নীচে তাপমাত্রা, রয়েছে নিম্নচাপের সম্ভাবনাও আগ্রা- লখনউ এক্সপ্রেসওয়েতে দুর্ঘটনায় ৫ জনের মৃত্যু রায়গঞ্জের কুলিকে শিশুর প্রাণ বাচিয়ে ডুবে মৃত্যু তরুণের গাজোলে মাটি খুড়তে গিয়ে উদ্ধার ১৬টি রুপার মুদ্রা

বৃহস্পতিবার   ১৪ নভেম্বর ২০২৪   কার্তিক ৩০ ১৪৩১   ১৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

সর্বশেষ:
মুর্শিদাবাদের সুতিতে শুট আউট। CSK-তে যাচ্ছেন ঋষভ? সামনে এল বড় খবর

রাজনৈতিক প্রচার ও তার প্রতিক্রিয়া

মজিবুর রহমান, প্রধানশিক্ষক, কাবিলপুর হাইস্কুল

প্রকাশিত: ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ০৮ ০৮ ৫৬  

রাজনৈতিক প্রচার ও তার প্রতিক্রিয়া 

মজিবুর রহমান, প্রধানশিক্ষক, কাবিলপুর হাইস্কুল 

 

     রাজনীতি হল নীতিগত লড়াইয়ের সর্ববৃহৎ মঞ্চ।রাজ্য বা রাষ্ট্র পরিচালনা তথা 'জনগণের সেবা' করার উপযোগী নীতি-আদর্শ নিয়ে রাজনৈতিক দল গঠিত হয়। লক্ষ্য এক হলেও পথ পৃথক হওয়ার জন্য আলাদা আলাদা দল তৈরি হয়ে থাকে। দলের ঘরোয়া বৈঠকে সেই পথ ও পন্থা সম্পর্কে আলোচনা করা হয়।আজকাল অবশ্য মতাদর্শের কথা বলার থেকে বিরোধী দলের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাল্টা অভিযোগ তোলার প্রবণতাই বেশি পরিলক্ষিত হয়।এই অভিযোগ পাল্টা অভিযোগের পথ ধরেই পার্টির প্রচারের কাজ এগিয়ে চলে। কিন্তু এই ধরনের প্রচারে মানুষ কতটুকু প্রভাবিত হয়? অভিযুক্ত ব্যক্তি বা দলের ওপর মানুষের মনোভাবে কতটুকু পরিবর্তন ঘটে? একটুখানি অনুসন্ধান করা যাক।

     জন্মলগ্ন থেকেই বিজেপি একটা মুসলিম বিরোধী হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক দল। স্বভাবতই বিরোধীরা বিজেপির বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িকতা তথা ধর্মের নামে বিভাজনের রাজনীতি করার অভিযোগ করেন।এই অভিযোগ একাধিকবার প্রমাণিতও হয়েছে। কিন্তু এর ফলে কি তারা রাজনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে? তেমন তো মনে হয় না।এটা ঠিক যে, হিন্দুত্ববাদী দল হওয়ার কারণে বিজেপিকে মুসলমানরা সাধারণত ভোট দেন না। বিজেপি বোধহয় মুসলমানদের ভোট প্রত্যাশাও করে না। তবু তারা জেতে।এর একটা সহজ গাণিতিক হিসাব রয়েছে। ঠিক যে কারণে বিজেপি মুসলমানদের ভোট পায় না ঠিক সেই কারণেই হিন্দুদের একটি অংশের ভোট ভোট পেয়ে থাকে। দেশের অধিকাংশ কেন্দ্রে ৮০ শতাংশ হিন্দু ভোটারের অর্ধেকের সমর্থন পাওয়াই বিজেপির জয়লাভের জন্য যথেষ্ট। সে লক্ষ্যেই তারা কর্মসূচি গ্ৰহণ করে এবং সফল হয়।কাজেই দেশের অহিন্দুদের জন্য বিজেপি কতটা মারাত্মক তার কাহিনী শুনিয়ে ভোটের রাজনীতিতে বিজেপিকে আটকানো সম্ভব নয়। বরং দেশবাসীর অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ মনন তৈরি করার ওপর জোর দেওয়া দরকার যাতে মানুষ কোনো সম্প্রদায়ভিত্তিক দলকেই সমর্থন না করে।একাজ করতে হলে ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দলগুলোর নেতানেত্রীদের ধর্মের ব্যাপারে নির্মোহ হতে হবে। ধর্মপালনকে ব্যক্তিগত স্তরে আবদ্ধ রেখে প্রকাশ্য ধর্মানুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত থাকতে হবে।দলবল নিয়ে মন্দিরে পুজো, মাজারে চাদর দেওয়া, ইফতারে অংশ নেওয়া বন্ধ করতে হবে।কৌশল হিসেবে নরম হিন্দুত্বকে আশ্রয় করা চলবে না।মনে রাখতে হবে, ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলোর পক্ষে নরম হিন্দুত্বকে হাতিয়ার করে বেশি সংখ্যায় হিন্দু ভোট পাওয়া সম্ভব নয়। হিন্দুদের যে অংশটা সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে ভোট দেয় তারা সত্যিকারের হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপিকেই দেবে। নতুন করে রাম নবমী'তে ছুটি দিয়ে অথবা দিঘায় জগন্নাথ মন্দির নির্মাণ করে টিএমসি বিজেপির কাছ থেকে হিন্দু ভোট ছিনিয়ে নিতে পারবে না। হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার তাস খেলে বিজেপিকে হারানো যাবে না।বরং বিজেপির হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা বাড়তে পারছে মুসলিমপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো সম্পর্কে ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলোর নরম মনোভাবের কারণে।যেমন, পীরজাদা নওসাদ সিদ্দিকীর আই এস এফ একটি সম্প্রদায়ভিত্তিক দল যার বেড়ে ওঠায় কয়েকজন বামপন্থী নেতার ভূমিকা অস্বীকার করা যায় না। ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে টিএমসি'র পেছন থেকে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সমর্থন সরানোর লক্ষ্যে ধর্মীয় নেতা আব্বাস সিদ্দিকীকে মদত দেওয়া হয়েছিল।আই এস এফ'কে সঙ্গে নিলে টিএমসি'র দুর্নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলনে জোর আসতে পারে কিন্তু বিজেপির সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াইটা দুর্বল হয়ে পড়ে।এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গে মুসলিমপন্থী আই এস এফের অস্তিত্ব যত প্রকট হচ্ছে হিন্দুত্ববাদী বিজেপির শক্তি তত বৃদ্ধি পাচ্ছে।সাম্প্রদায়িক দলের সঙ্গে ধর্মনিরপেক্ষ দল একসাথে বেশিদিন চলতেও পারে না। ১৯৮৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে জাতীয় স্তরে বিজেপির সঙ্গে এক মঞ্চে অবস্থান আর রাজ্যে আই এস এফের সঙ্গে তিন বছরের বন্ধুত্বের ফল বামেদের পক্ষে ভালো হয়নি কিন্তু ওই দুই সাম্প্রদায়িক দল অনেক লাভবান হয়েছে। মমতা ব্যানার্জি বিজেপির প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ীর মন্ত্রিসভার সদস্য থেকেছেন, একাধিকবার জোট বেঁধে ভোটে লড়েছেন।আজ যখন রাজ্যে প্রধান প্রতিপক্ষ হয়ে উঠেছে তখন বিজেপির বিরুদ্ধে টিএমসি'র সাম্প্রদায়িকতার অভিযোগের গুরুত্ব থাকে না।বিজেপির বিরুদ্ধে বিভিন্ন দলের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বানেই বা কতটুকু আন্তরিকতা থাকে? দেশ নয় দলীয় স্বার্থেই সাধারণত জোট বাঁধার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করা হয়।তাই বিজেপি বিরোধী জোটের জট কখনও কাটে না এবং লোকসভা নির্বাচনেও স্থানীয় ইস্যু তুলে জাতীয় ইস্যুকে লঘু করে দেওয়া হয়। পশ্চিমবঙ্গ সহ একাধিক রাজ্যে সেটাই ঘটতে দেখা যাচ্ছে। 

     টিএমসি'র দুর্নীতি নিয়ে বিরোধীরা সকলেই সোচ্চার।উঠতে বসতে টিএমসি'কে চোর বলা হচ্ছে। দুর্নীতির অভিযোগে টিএমসি'র বেশ কয়েকজন নেতাকর্মী জেল খাটছেন। দলটির দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নেতা অভিষেক ব্যানার্জিকে এখনও পর্যন্ত জেলবন্দি করতে না পারার আক্ষেপ ও অসন্তোষ প্রতি মুহূর্তে ঝড়ে পড়ছে বিরোধী দলের নেতৃবৃন্দ সহ কলকাতা হাইকোর্টের একাধিক বিচারপতির কণ্ঠে। মেইন স্ট্রিম প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় শাসকদলের দুর্নীতি নিয়ে তীব্র সমালোচনা চলছে। ২০২১ সালে মমতা ব্যানার্জি তৃতীয় বারের মতো সরকার গঠনের কয়েক মাস পর থেকে দুর্নীতি নিয়ে যত কথা হয়েছে, টিএমসি'র নেতাকর্মীদের বাড়িতে যতবার ইডি, আইটি, সিবিআই তল্লাশি চালিয়েছে, যত টাকা পয়সা বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে স্বাধীন ভারতে পশ্চিমবঙ্গ তো বটেই অন্য কোনো রাজ্যেও এমন ঘটনা কখনও ঘটেনি। গত আড়াই-তিন বছর ধরে সরকার ও শাসকদলের দুর্নীতি নিয়ে এতো তোলপাড় চলছে কিন্তু জনগণকে কি সাংঘাতিক ক্ষুব্ধ বা ক্ষিপ্ত হতে দেখা যাচ্ছে?মনে তো হচ্ছে না। চাকরি বাকরি করেন, ব্যবসা থেকে ভালো উপার্জন হয়, আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য আছে, দেশ কাল সমাজ নিয়ে চিন্তা ভাবনা করার অবকাশ পান এমন মানুষের সংখ্যা শতকরা কুড়ি-পঁচিশ জন। বাকি পঁচাত্তর-আশি ভাগ মানুষই দু'মুঠো রুজি রুটির ব্যবস্থা করতে প্রতিদিন ব্যস্ত থাকেন। হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করেন। তাঁদের অধিকার নিয়ে ভাবার অবকাশ নেই। এদিক ওদিক থেকে সরকারি বেসরকারি যেকোনও অনুদান, ভাতা পেলে তাঁরা খুশি হন। যারা তা দেয় তাদের প্রতি তাঁরা কৃতজ্ঞতা প্রদর্শন করেন। তাঁরা নেতানেত্রীদের গাড়ি বাড়ি বিষয় সম্পত্তি নিয়ে মাথা ঘামান না। সাধারণভাবে মনে করেন, যে যায় লঙ্কা সে হয় রাবণ। কাজেই দুর্নীতি করার কারণে টিএমসি'র জনসমর্থনে সাংঘাতিক ধস নেমেছে এমনটা বলা যাবে না। 

     আসলে দুর্নীতির একটা সামাজিকীকরণ ঘটে গেছে। সমাজ জীবনের সর্বত্র তা ছড়িয়ে পড়েছে। দুর্নীতি আজ আর কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়; প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পরিগ্রহ করেছে।সংগঠিতভাবে বা চেইন সিস্টেমে সম্পন্ন হচ্ছে।সিংহভাগ মানুষই কোনো না কোনোভাবে দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত।যার যেমন ক্ষমতা সে তেমন দুর্নীতি করে। অনেস্টি ইজ দ্য বেস্ট পলিসি- এই প্রবচন ক'জন ব্যক্তিগত জীবনে প্রয়োগ করে? বাস্তব সত্য হল, আজকের সমাজ ব্যবস্থায় সৎ থাকাটাই কঠিন।সততা নিয়ে চলার জন্য যে মানসিক দৃঢ়তা ও উন্নত আদর্শবোধ থাকা দরকার তা খুব বেশি জনের পক্ষে অর্জন করা সম্ভব হয় না।যেমন, হাজার হাজার চাকরিপ্রত্যাশী নিজেরা লাখ লাখ টাকা শাসকদলের নেতাকর্মীদের হাতে তুলে না দিলে এতবড় নিয়োগ দুর্নীতি হওয়া সম্ভব ছিল না। এঁরা সবাই এই দুর্নীতির স্টেকহোল্ডার। দুর্নীতির কারণে যাঁরা চাকরি পাননি তাঁরা যদি শাসকদলের বিপক্ষে থাকেন তবে অবৈধভাবে যাঁরা চাকরি পেয়েছেন তাঁরা শাসকদলের পক্ষে আছেন। অর্থাৎ দুর্নীতির অভিযোগে ভোটের অঙ্কে শাসকদলের খুব একটা ক্ষতি হচ্ছে না। যেভাবে বিভিন্ন পেশাজীবীদের দুর্নীতির শৃঙ্খল স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে সেভাবেই নেতানেত্রীদের দুর্নীতি এখন আর অস্বাভাবিক ঘটনা বলে মনে করা হয় ন। এটা সর্বসাধারণের গুরুতর মানসিক অবক্ষয়।এই মানসিক অবক্ষয় রোধ না হলে দুর্নীতিগ্ৰস্ত দল বা নেতানেত্রীদের ভোটে ভরাডুবি হবে না। ভোটের রাজনীতিতে সৎ রাজনীতিকরা কোনো বাড়তি সুবিধা পাচ্ছেন না। তাঁরা শ্রদ্ধা, ভালোবাসা পান কিন্তু ভোট পান না। আসলে যা হওয়া উচিৎ বলে মনে করা হয় বাস্তবে তা অনেক ক্ষেত্রেই হয় না।

       'শত্রুর শত্রু মিত্র' ফর্মুলা অনেকসময়ই বুমেরাং হয়ে দেখা দেয়। পশ্চিমবঙ্গে বাম-কংগ্ৰেসের জন্য পদত্যাগী বিচারপতি তথা বিজেপি প্রার্থী অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় এই ঘটনার সাম্প্রতিক উদাহরণ। উনি নিয়োগ দুর্নীতির বিচার প্রক্রিয়ায় নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় কাজ করছিলেন কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই তা নিয়ম মেনে করা হচ্ছিল না।রীতি ভেঙে সংবাদমাধ্যম দীর্ঘ সাক্ষাৎকার দিলেন। রাস্তাঘাটে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করলেন। রাজনৈতিক দলের শাখা সংগঠনের মঞ্চে গিয়ে বক্তৃতা দিলেন। এজলাসে বসে অতিরিক্ত অবান্তর কথা বলতেই থাকলেন। পদ ও প্রতিষ্ঠানের ওপরে ওঠার অপচেষ্টা অব্যাহত রইলো।তবু তাঁর প্রশংসা ও স্তুতি হতেই থাকল কারণ তখন তিনি রাজ্য সরকার ও শাসকদলের বিরুদ্ধে 'প্লেয়িং টু দ্য গ্যালারি' খেলছিলেন। সেই তিনি বামেদের বুড়ো আঙুল দেখিয়ে 'পারিবারিক পার্টি' জাতীয় কংগ্রেসের অস্তিত্ব খুঁজে না পেয়ে তৃণমূলকে দংশন করতে 'বেলেবোরা' হয়ে বিজেপি'তে যোগদান করলেন। তিনি আজ গান্ধী ও গডসের মধ্যে একজনকে বেছে নিতে পারেন না। আদালতের 'ভগবান' রাজনীতিতে এসে 'শয়তান' হলেন।বিচিত্র ভারতে বোধহয় রাজনীতির মতো বিচিত্র অন্য কিছুই নেই।

(লেখকের নিজস্ব মতামত)

Puspaprovat Patrika
এই বিভাগের আরো খবর