ব্রেকিং:
আরজি কর মেডিকেলে ২০০ কোটির দুরনীতি, একাধিক প্রভাবশালীর জোগ থাকার সম্ভাবনা নলপুরে বেলাইন সেকান্দ্রাবাদ-শালিমার এক্সপ্রেস চলতি মাসেই ২০ ডিগ্রির নীচে তাপমাত্রা, রয়েছে নিম্নচাপের সম্ভাবনাও আগ্রা- লখনউ এক্সপ্রেসওয়েতে দুর্ঘটনায় ৫ জনের মৃত্যু রায়গঞ্জের কুলিকে শিশুর প্রাণ বাচিয়ে ডুবে মৃত্যু তরুণের গাজোলে মাটি খুড়তে গিয়ে উদ্ধার ১৬টি রুপার মুদ্রা

মঙ্গলবার   ২৬ নভেম্বর ২০২৪   অগ্রাহায়ণ ১২ ১৪৩১   ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

সর্বশেষ:
মুর্শিদাবাদের সুতিতে শুট আউট। CSK-তে যাচ্ছেন ঋষভ? সামনে এল বড় খবর

মামুনী

বেদশ্রুতি মুখার্জি

প্রকাশিত: ২৫ জানুয়ারি ২০২০ ০৮ ০৮ ৩৫  

যাদবপুর ইউনিভার্সিটির ডাকসাইটে নামকরা অথচ কড়া এই কম্পারেটিভ লিটারেচার এর ম্যাম সবার কাছে আতঙ্ক, অথচ একইসঙ্গে অমোঘ আকর্ষণীয়াও। ম্যাম নিজেই কার ড্রাইভ করে রোজ ভার্সিটিতে আসেন, সব সময় পরনে থাকে সুন্দর সুন্দর চুড়িদার। দামী চশমায় ঢাকা অপূর্ব সুন্দর মুখখানি যেন আরোপিত গাম্ভির্যে লিপ্ত, বয়স বোঝা যায় না, অফিসের ক্লার্কের থেকে আমাদের কৌতূহলী স্টুডেন্ট দের আনা রিপোর্ট বলে, ম্যামের আর মাত্র পাঁচবছর চাকরি অবশিষ্ট, তাহলে তো পঞ্চান্ন বছর বয়স, অথচ দেখে চল্লিশের বেশি মনে হয় না, এত সুন্দর গড়ন শরীরের আর অবশ্যই মনেরও। কথাবার্তা ও অপূর্ব, অমায়িক, আবার ক্লাসরুমেই এই মানুষটি প্রচণ্ড কড়া, পড়া না পারলে আবার আমাদের বেঞ্চের ওপর দাড় করিয়ে রাখেন, আর যাদের সদ্য প্রেম বা চারচোখের মিলন শুরু হয়েছিল, তাদের জন্য তো প্রেস্টিজ এর দফারফা, এ হেন জাঁদরেল কড়া আকর্ষণীয় মহিলার ওপর আমার আকর্ষণ এর পারদ ক্রমেই পেঁয়াজের দামের মতই বাড়ছিল। শুনেছি ম্যামের নাকি একটাই ছেলে, আবার কেউ কেউ বলেন, বিয়েই করেননি উনি, ছেলেটা দত্তক নেওয়া নাকি, ডাক্তারি পড়ে। আসলে সিঙ্গেল মহিলাদের ওপর সকলের কৌতূহল এর শেষ থাকে না। আমি ম্যামের বাড়িতে একবার আমার রিসার্চ এর প্রজেক্ট দেখাতে গেছিলাম একবার, ঢুকেই ড্রয়িং, সামনের দেয়ালে থরে থরে সাজানো ওনার দেশ বিদেশে কনফারেন্সের বা পুরস্কার প্রাপ্তির ছবি। ম্যাম ঢুকেই বললেন,- "খেয়ে যাবি"... প্রজেক্টের কথার বদলে খাওয়ার কথায় চমকে উঠলাম আমি, যেন এতদিনের কড়া রাগী ম্যামের মধ্যে এক স্নেহের ফল্গুধারা আজ চোখে পড়ল, আমার মা নেই, তাই কোনদিনই ভার্সিটিতে খেয়ে আসা হয়না, উনি তারপর সংযোজন করে আরো বলেছিলেন, আমি জানি তোর খাওয়া হয়না আসার সময় তাড়াহুড়োয়, আজ থেকে আমার কোয়ার্টার এ আগে চলে আসবি, একসাথে খেয়ে আমার গাড়িতেই আমার সঙ্গে ডিপার্টমেন্ট যাবি। চোখ ভিজে এলো, মুখ দিয়ে অস্ফুটে বেরোলো-"মামুণি"... ভাগ্যিস বলে ফেলিনি, উনি তো আমার ম্যাম, আমার মামুণি তো কোথাও নেই। তবে এতটা স্নেহময়ী ম্যাম পাইয়ে দেওয়াও বোধহয় আমার মামুণিরই কাজ। মাঝে মাঝে তারপর থেকে আমি ওই বাড়িতে যেতাম প্রায়ই, একদিন দেখা হয়ে গেল ম্যামের ছেলের সঙ্গে, অবাক করল ওর নামটা আব্দুল এহমদ হুসেন সাহিত্য, সাহিত্য আমার থেকে দুই বছরের ছোট, ও আমায় দিদি বলে ডাকে, অবাক হলাম কারণ ম্যামের নাম মধুরিমা চ্যাটার্জি, আর ছেলে মুসলিম, তবে যেটা শুনেছি বোধহয় ওটাই ঠিক, ম্যাম সাহিত্য কে দত্তক নিয়েছেন, আর ওনার মত বিশাল সমুদ্রের মত হৃদয়ধারী মহিলা সন্তান নির্বাচনের সময় কী আর হিন্দু মুসলিম বিচার করবেন, প্রশ্নই আসে না। একবার কোয়ার্টার এ গিয়ে দেখি, কাজের বুয়া কাজ করছেন ঠিকই, ম্যাম লিখছেন, তবে সাহিত্য নাকি ওর বাড়ি গেছে বললেন ম্যাম, আমি ফেসবুকের মাধ্যমে আজ সাহিত্য র জন্মদিন জেনেই ওর জন্য দিদি হিসেবে একটা জামা নিয়ে গেছিলাম, ভেবেছিলাম আজ বোধহয় ছোটখাটো অনুষ্ঠান হবে ওখানে, গিয়ে শুনি এসব, আরো অবাক হলাম, সাহিত্য যদি অনাথই হয়, তবে ওর আবার বাড়ি কীসের আর ম্যাম মানে ওর মামুণিকে ছেড়ে আজকের দিনে ও চলে গেল আশ্চর্য। অধৈর্য্য হয়ে এই প্রথম ম্যামকে জিগ্যেস করে বসি-ম্যাম সাহিত্য ভাইকে আজ আপনি কোথায় পাঠালেন? ম্যাম আবার শান্ত স্বরে বললেন, "ওর বাড়িতে", আমি না পেরে বললাম, "মাকে ছেড়ে ওইবা কেমন চলে গেল"। জানি না হয়তোবা এতদিনের বিশ্বাস থেকে অথবা একাকীত্বের অতলে তলিয়ে, অসমবয়সী দুই নারী আজ আমরা ছাত্রী ম্যাডামের গণ্ডি পেরিয়ে এই প্রথম বন্ধু হয়ে উঠলাম, দেখলাম ম্যাম আমার কাছে মুখ খুললেন, আর বললেন-" সাহিত্য আমার নিজের সন্তান, কিন্তু আমার গর্ভজাত নয় রে, ওর নিজের মা আছে, আর আমি তো ওকে জোর করে নিজের কাছে এনে রেখেছি, বছর কয়েক হলো, তাই জন্মদিনে ওকে ওর মা আব্বুর কাছে যেতে দেব না তাই কী হয় বল"।আমি মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনতে লাগলাম, মনে হলো যেন আযান আর গীতার মন্ত্র কোথাও যেন একসুরে বাজছে ম্যামের কণ্ঠে, ম্যাম আরো বললেন, "আমি বিয়ে করিনি আজীবন, ভালো বেসেছিলাম একজনকে, ধর্ম সেখানে অন্তরায় হয়ে জাঁকিয়ে বসে, দুজনেই চাকরি করতাম আমরা যদিও, তবুও সাহস হয়নি আর তাছাড়া পরিবারের সবাইকে খুশি করতে গিয়ে নিজের সুখের গলাটা টিপতে বাধ্য হই, ও অনেক বছর অপেক্ষা করার পর একসময় বিয়ে করে, সেদিন থেকেই ওনার সঙ্গে সব যোগাযোগ ছিন্ন হয়, এতেই সুখী হয়েছিলাম যে উনি তো সুখী হয়েছেন, প্রায় আঠেরো বছর পর একদিন সেমিনার করতে যাই শিলিগুড়ি মেডিকেল কলেজে, দেখি এক ছাত্রের মুখের আদল একদম আমার সেই আল্লাতালার মত, হ্যাঁ উনি আমার কাছে আল্লাতালাই, বা বলতে পারিস আমার ভগবান, যেই নামে ঈশ্বর কেই ডাক না কেন, সব তো আদতে এক, তো আমি খুব কৌতূহলী হয়ে ছেলেটির নাম জানতে চাই, শুনি আব্দুল অহমেদ হুসেন সাহিত্য, ছেলেটি সবচেয়ে বেশি নম্বর নিয়ে গ্রামের স্কুল থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে শিলিগুড়ি মেডিক্যাল এ ডাক্তার তে চান্স পেয়েছে, কিন্তু এখন নাকি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, ভীষণ নেশায় আসক্ত, ড্রাগ অ্যাডিক্ট, ওনার বাবা মাকে ও সবটুকু খুলে বলা হয়েছিল, ওনারাও অনেক বার ওকে নিয়ে গেছেন, কিন্তু কিছুতেই সংশোধন করতে পারছেন না, ছেলেটির একবছর ড্রপও গেছে এসবের কারণে, শুনেই আমি অফিসে গেলাম আর ক্লার্ক কে বললাম, ছেলেটির বাবা মার নাম কী দেখুন তো, সঙ্গে বাড়ির অ্যাড্রেসটাও। ঠিক যেটা আশঙ্কা করছিলাম সেটাই ঘটলো, হ্যাঁ ছেলেটিই আমার সেই আজন্ম তপস্যার ফল, আমার সেই ঈশ্বর তুল্য প্রেমিক এর সন্তান, ব্যস আর অপেক্ষা করিনি, ড্রাইভার কে বললাম, গাড়ি ছোটাও, দীর্ঘ চারঘন্টা জার্নি করে যখন আমার গাড়িটা সেই গ্রামে ঢুকল, তখন এশার আযান হচ্ছে, ওর বাড়ি চিনে গিয়ে দেখি, ও সদ্য স্কুল থেকে ফিরেছে, আর বৌ বোধহয় চা জলখাবার দিয়েছে, খাচ্ছে বারান্দায় বসে, আমি খুব একটা পাল্টাইনি, আসলে সংসার করিনি তো তাই হয়তোবা চেহারায় ছাপ পড়েনি, তবে কাঁচাপাকা দাড়িতে আর চশমায় ওকে ঠিক দেবদূতের মতোই লাগছিল, যাকে ইউনিভার্সিটি তে বকতাম, মারতাম, অনর্গল বকবক করতাম, সেই মানুষটি কে আজ এত বছর পর দেখে কেন জানি না অজান্তেই হাতটা তার পায়ের কাছে চলে গেল, পায়ের ধুলো নিয়ে উঠে বললাম- "ছেলের ভার দে, তোদের সাহিত্য কে আমার হাতে তুলে দে, মনে আছে, আমাদের ই শখ ছিল ছেলে বা মেয়ে যাইহোক, সে খুব বড় ডাক্তার হবে, আমি করে আনব ওকে সফল ডাক্তার, সব নেশা ছাড়িয়ে। ভেবেছিলাম হয়তোবা আমার কথা ওর বৌকে আঘাত দেবে, তাই বেরিয়েই যাচ্ছিলাম- ও বিবাহিত, আজ অন্যের মনে পড়ে। ওর বৌ ছুটে এসে হাতটা আমার ধরে বললেন-

"এতবছর পর বোনকে দেখতে এলে দিদিভাই'... ওর চোখে দেখি জল, ঠিক শেষ দিনের বিদায় বেলার মত। বুঝলাম ও সব বলেছে তাঁঁকেও, এটাই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় স্বীকৃতি প্রাপ্তি, ধর্ম তো অনেক খেলা খেলেছিল যাতে আমি জীবনে কিচ্ছু না পাই, কিন্তু সে আজ পরাজিত, আমার ভালোবাসা জয়ী হয়ে গেল এখানেই। তারপর ওরা এককথায় আমায় সাহিত্যর ভার দিয়ে দেয়, আমি টিসি সার্টিফিকেট সহ অ্যাডিক্টেড অবাধ্য ছেলেটাকে নিয়ে আসি আমার ইউনিভার্সিটি তে, এই যাদবপুর এ, অনেক দিন ছুটি নিয়ে ছিলাম, অনেক কষ্টে ধীরে ধীরে ও নেশামুক্ত হয়ে সফল হয় নিজের জীবনে, ভালো ভাবে MBBS পাশ করে এখন মাস্টার্স করছে কার্ডিওলজির ওপর, কারণ আমার মা হার্ট অ্যাটাকে মারা যায় ওর সামনেই, ও তাই চায় বড় হার্ট স্পেশালিস্ট হতে, যাতে আর কারোর চিকিৎসার অভাবে মৃত্যু না হয়। ওর বাবার সঙ্গে সেদিনের পর আর কখনো দেখাও করিনি, কথাও বলিনি, কারণ ও তো অন্যের, যেটুকু দরকারি কথা থাকে, ওর মার সঙ্গে ই ফোনে সেরে নিই, সাহিত্যও জানে আমি ওর মায়ের বান্ধবী, তাই আমায় শুধু মামুণি বলে ডাকে।" ম্যামের ত্যাগ তিতিক্ষার কথা শুনে আমার মনে হলো এটাই ধর্ম, মানবতা আর এতটা নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসা, চোখ মুছে বললাম, মামুণি... সেই থেকে ইউনিভার্সিটি জুড়ে আমার দেখাদেখি সবাই তাঁকে মামুণি বলা শুরু করলো, সত্যিই তো উনি মা, জগতের মা, প্রেম আর ত্যাগের প্রতীক দেবী মা, মা হওয়া নয় মুখের কথা, প্রসব করলেই শুধু হয়না মাতা। আমাদের মামুণিকে ঈশ্বর আর আল্লাতালা সকলের মা বানানের জন্য ই বোধহয় সংসার এবং মাতৃত্ব থেকে বঞ্চিত করেছেন, মামুণি একটা মানুষ নন, একটা উপাখ্যান......

Puspaprovat Patrika
এই বিভাগের আরো খবর