গল্প - অস্তরাগে দাঁড়িয়ে
খগেন্দ্রনাথ অধিকারী
প্রকাশিত: ১৫ মে ২০২৪ ১৮ ০৬ ৩০
অস্তরাগে দাঁড়িয়ে
খগেন্দ্রনাথ অধিকারী
বেলা প্রায় বারটা বাজে। বৃদ্ধ শিক্ষক কাদেরী সাহেব স্নানে যাবেন। এমন সময় আমির সোয়েল ও তার শ্বশুর মশায় জাকির খান এসে হাজির--
--আদাপ স্যার।
--আদাপ। বসুন বসুন। কখন বেরিয়েছেন? স্যার সকাল আটটায়। কিন্তু, রাস্তায় জ্যাম। তাই আসতে দেরী হয়ে গেলো জামাইকে নিয়ে।
--ঠিক আছে, ঠিক আছে।
বৌমাকে হাঁক পাড়লেন--মা সালমা! আগে ওঁদের একটু কিছু খাওয়াও।
--জি আব্বা। এখনই ব্যবস্থা করছি আমি।
--না, মা, তার আগে তোমার এই চাচাজীর একটা ছোট্ট অনুরোধ রাখো। এই ব্যাগ দুটো আগে ভিতরে নিয়ে গিয়ে সদ্গতি করো মা।
--ওতে কি আছে জাকির ভাই?
--স্যার, আপনাদের এখানে আসবো বলে ভোরে পুকুরে জাল টেনেছিলাম। ইনস্ আল্লা আমার কপালও ভালো। এক খ্যাপোনেই কিস্তি মাৎ-- গলদা চিংড়ি, কাতলা ও মাগুর মাছ মিলে প্রায় কুড়ি কিলো মাছ পড়েছে। জাল টেনে ডাঙ্গায় তোলাই দায়। তার থেকে কিছু মাছ বাড়ীতে খাবার জন্য রেখে এসেছি--বাকীটা এনেছি আপনার জন্যে।
--ধন্যবাদ জাকির ভাই। আপনি কিনে আনলে নিতাম না। আপনার পুকুরের জিনিষ। ভালোবেসে এনেছেন। এটা ফেরৎ দিলে আপনাকে অসম্মান করা হবে; আমার অহংকার প্রকাশ পাবে। সৃষ্টিকর্তার বিচারে এটা আমার গোনা হবে। তাই আমি ফেরাবো না--কিন্তু এতো মাছও আমি নেবো না। আপনি এই মাছের চার ভাগের একভাগ আমায় দিন: আমরা মাত্র সাড়ে চারটে প্রাণী--আমরা স্বামী--স্ত্রী; ছেলে বৌমা ও পাঁচমাসের নাতনি। বাকীটা আপনি ভাই বাড়ী নিয়ে যান।
--স্যার! আমি আপনাকে চিনি অনেক দিন থেকে। আপনার ছোট ভাই-এর মতো আমি। আসতে অনেক বেলা হয়েছে আমার রাস্তার জন্যে। এতো বেলায় এতটা পথ আবার যাবো। ফেরৎ নিলে মাছগুলো পচে যাবে। ফেলে দিতে হবে। ভাবীজানকে বলুন--ফ্রিজে রেখে দিতে। দু-তিনদিন ধরে খাবেন; না হয় আত্মীয় স্বজনকে কিছুটা দেবেন। ওগুলো ফিরিয়ে দেবেন না স্যার।
অগত্যা জাকির সাহেবের অনুরোধ মত তিনি প্যাকেটটা নিয়ে স্ত্রীকে ভিতরে গিয়ে দিয়ে এলেন এবং মেহেমানদের জন্যে একটু দ্রুত নাস্তার ব্যবস্থা করতে বলে এলেন পুনরায়।
--এবার বলুন ভাই, কেমন আছেন?
--স্যার, আপনার আশীর্বাদে ও আল্লা পাকের অসীম রহমতে ভালো আছি। সেজন মুখ তুলে চেয়েছেন আর আপনার একাগ্রতা, তাই আমীর চাকরির পরীক্ষায়, HS-এ শিক্ষক পদে সফল হয়েছে। চিঠি এসেছে। পরশুদিন Join। তাই এসেছি স্যার।
--বাঃ, বাঃ, খুব ভালো খবর।
--স্যার! অনেক বেলা হয়েছে। আপনারও বয়স হয়েছে। চান--খাবার সময় আপনার। তাই স্যার আপনাকে দেরী করাবো না। শুধু একটা মিনতি করতে এসেছি।
--আরে ছোট ভাই। মিনতি কেন? বলুন বলুন।
ইতিমধ্যে বৌমা জলখাবার নিয়ে হাজির--একটু মুখে দিন চাচাজী। কখন বেরিয়েছেন!
--আবার এসব কেন মা?
--তা হোক। এইটুকু মুখে দিন। না হলে মা খুব কষ্ট পাবেন--তিনিই হাতে করে তাড়াতাড়ি বানিয়েছেন।
খেতে খেতে খান সাহেব বলেন--
স্যার! আপনার অসাধারণ গাইডেন্সে এক চান্সেই আমীর সফল হয়েছে। আপনি সময় দিয়েছিলেন তিন বছর। নাম মাত্র একটা দান নিয়ে বলেছিলেন যে তিন বছরের মধ্যে আমার জামাই সফল না হলে সুদসহ টাকাটা ফেরৎ দিয়ে দেবেন। আমি জানি আপনি অসফল কয়েকজনকে এইভাবে টাকা ফেরৎ দিয়ে-দিয়েছেন। আমি এও জানি যে আপনি ঐ অগ্রিম দান খরচ করেন না--তৃতীয় কোন ব্যক্তির কাছে জমা রাখেন। সফল হলে ঐ দানের টাকায় গরীব দুঃখীদের আপনি সাহায্য করেন। অসফল হলে সুদসহ ফেরৎ দিয়ে দেন।
একটু থেমে জাকির সাহেব বলেন--
জানেন স্যার। মাঝে মাঝে নিজের মধ্যে কৌতুহল হতো যে দান, অথচ আগে জমা রাখছেন তৃতীয় ব্যক্তির হাতে, Candidate একটা নির্দ্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সফল না হলে সুদসহ টাকা ফেরৎ দিচ্ছেন, এর রহস্যই কি? পরে জেনেছি, আসলে অধিকাংশ মানুষ অসৎ। আপনি নামমাত্র একটা দানের অনুরোধে দু-তিন বছর ধরে পড়িয়ে একটি ছাত্র বা ছাত্রীকে চাকরির পরীক্ষায় কোয়ালিফাই করছেন। অথচ কোয়ালিফাই করার পর ঐ নাম মাত্র দান টুকুও অনেকে দেয় না গরীব মানুষের সমাজ সেবার কাজে। আপনি নিজের আরামের জন্য তো এটা নেননা। এতো আপনি উভয় দিক দিয়ে সমাজের কল্যাণ করছেন। একদিকে একটি পরিবারকে অন্নকষ্ট থেকে বাঁচাচ্ছেন। অন্যদিকে তাদের দেওয়া নামমাত্র দানে গরীব মানুষের সেবা করছেন। আর যারা দিতে পারে না তাদের তো সব মাফ। পকেট থেকেই তাদের বইপত্র কিনে দেন।
ছেলেবেলায় পড়েছিলাম যে রাজ্য শাসনের অবকাশে ঔরঙ্গজেব টুপি সেলাই করে তা বিক্রি করে ইসলামের প্রচারে ব্যয় করতেন। আর ছত্রপতি শিবাজী রাজ্য শাসনের ফাঁকে তাল পাতায় গীতার বাণী লিখে বিক্রি করে তা দিয়ে হিন্দু রাষ্রেস্র প্রচারে ব্যয় করতেন। আর আজ মানব ধর্মে আপনার ভূমিকা দেখছি স্যার।
--আপনি জাকির ভাই আমায় নিয়ে এতো ভাবেন?
--ভাববো না স্যার! সবাই যদি অমন উন্নত আদর্শ নিয়ে চলতো, তাহলে সমাজটা অন্যরকম হতো।
--এই বলে আমায় লজ্জা দেবেন না জাকির ভাই।
-- লজ্জা দেওয়া নয় স্যার। সর্বশক্তিমান সৃষ্টিকতা আপনার মত মানুষ এই পৃথিবীতে আরো পাঠান। এই কামনা করি। চারিদিকে বেকার ছেলে মেয়েদের রক্ত চোষার ফাঁদপাতা। একদিকে বিভিন্ন কোচিং সেন্টারগুলোর ঠগবাজি। অন্যদিকে মন্ত্রী, আমলা সবাই চোর--বেকারদের চাকরিদেবার নামে চারিদিকে ফুলের ছড়াছড়ি--ধুঁধরো ফুল, পারথানিয়াম ফুল, ঘেঁটকুল ফুল, ইত্যাদি। এর ভিঁড়ে আপনি স্যার অখ্যাত জঙ্গলে থাকা, এই অখ্যাত গ্রামে থাকা এক কাঠমল্লিকা লতা। আপনি শতায়ু হোন। আর যে মিনতির কথা বলছিলাম, তা হোল এই যে এই খামটা দয়া করে আপনাকে রাখতে হবে গরীবদের সেবার কাছে।
--কি ওটা জাকির ভাই?
--এটা একটা প্রণামী! দরিদ্র মানুষদের সেবায় আপনার পায়ে প্রণামী--আমীরের দুই মাসের সম্ভাব্য মাহিনা বাবদ এক লক্ষ টাকার একটি বেয়ারার চেক স্যার। দয়া করে এটা নিন।
--জাকির ভাই, আমার শিক্ষকতার জীবনে অনেক ছাত্র ও অভিভাবককে পেয়েছি; অধিকাংশই খুব বুদ্ধিমান। দু-এক জনকে পেয়েছি যারা খুব নির্বোধ ও বোকা। আজ সেই নির্বোধদের তালিকায় আরো দুটি নাম সংযোজিত হোল--(১) জাকির খান ও (২) তাঁর জামাই আমির সোয়েল।
জাকির সাহেব একটু ভ্যাবাচাকা মেরে গেছেন দেখে তাঁর পিঠে হাত রেখে কাদেরী স্যার--বললেন--ভাই, যাদের পয়সা আছে, তারা শিক্ষকদেরকে ভিখারী বলে মনে করে। পরীক্ষায় কোয়ালিফাই না করলে সে দায় শিক্ষকের; আর কোয়ালিফাই করলে সব কৃতিত্ব ছাত্রের। শিক্ষকের guidance-এর কোন মূল্যায়নই হয় না। তখন দরিদ্রদের সেবায় ঐ শিক্ষকের হাতে সামান্য দান দিতে কষ্ট হয়। তাই তো বাধ্য হয়েই, আমাকে অগ্রিম দানের ও কোয়ালিফাই না করলে দান ফেরতের নিয়ম চালু করতে হয়েছে। আপনি তো ভাই যথারীতি অগ্রিম দান তৃতীয় পক্ষের হাতে আমিরের ভর্তির সময়েই দিয়ে রেখেছেন। আমি তাতেই সন্তুষ্ট; গরীবদের সেবায় এটা খুব কাজে লাগবে। কিন্তু, আজ আবার এই লাখ টাকার চেক কেন ভাই?
-- না স্যার, এটাও গরীবদের কাজে লাগাবেন আপনি। আপনি তো মানুষ নন স্যার; আপনি মানুষরূপে ফেরেস্তা।
--ছিঃ ছিঃ ভাই। এমন বলবেন না। আমি স্রষ্টার একজন নগন্য বান্দা মাত্র। আল্লার কাছে দোয়া করবেন আমি এবং আমার ছেলে--বৌমারাও যেন এমনিভাবে সারাজীবন গরীবের সেবা করতে পারেন। তবে হ্যাঁ, এই চেকটা আপনি নিয়ে যান। ব্যাঙ্কে টাকাটা রাখুন। যখন গরীবের কাজে লাগবে তখন সেটুকু করে টাকা আপনার থেকে আমি বা আমার অবর্তমানে আমার ছেলে বৌমা চেয়ে নেবে। ততক্ষণে ব্যাঙ্কে রাখলে টাকাটা তো বাচ্চা পাড়বে।
দুপুর হয়ে গেছে। সূর্য্য মাথার উপরে। স্ত্রী-বৌমা ও স্যার স্বয়ং জাকির ভাই ও তাঁর জামাইকে একটু বসে ভাত খেয়ে যেতে অনুরোধ করলেন।
আমীর বোললো--না খালামা! আপনি যা নাস্তা খাইয়েছেন, সন্ধ্যের আগে পর্যন্ত খিদে হবে না। দোয়া করবেন আমার ও আব্বাজানের জন্য।
ওঁদের গাড়ী ছেড়ে দিল। হু হু করে মারুতি ছুটে চলেছে। জানলার ফাঁক দিয়ে জাকির সাহেব তপ্ত সোনালী সূর্য্যটার দিকে তাকিয়ে ভাবেন যেন সে এখন অস্তাচলে, এবং তার সেই অস্তরাগে দাঁড়িয়ে সারা দেহে মুঠো মুঠো লাল আবির মেখে স্থির হয়ে আছেন অশীতিপর শিক্ষক কাদেরী সাহেব জানা অজানা অগনিত মানুষের শ্রদ্ধা--সালাম--প্রণাম নিয়ে।
লেখক পরিচিতি
অধ্যাপক খগেন্দ্রনাথ অধিকারী রাষ্ট্রীয় বিদ্যাসরস্বতী পুরস্কার ও এশিয়া প্যাসিফিক পুরস্কার সহ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বহু পুরস্কার প্রাপ্ত একজন খ্যাতনামা শিক্ষাবিদ। ইনি কোলকাতার সাউথ সিটি (দিবা) কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ।
ঠিকানা-শরনিয়ার বাগান
পোষ্ট-টাকী, পিন-৭৪৩৪২৯
পশ্চিমবঙ্গ, ভারত
- আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় মুর্শিদাবাদ সেন্টারে অনুষ্ঠিত হল `জন জাতীয় গৌরব দিবস ২০২৪`
- আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় মুর্শিদাবাদ সেন্টারে অনুষ্ঠিত হল `জন জাতীয় গৌরব দিবস ২০২৪`
- আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় মুর্শিদাবাদ সেন্টারে অনুষ্ঠিত হল `জন জাতীয় গৌরব দিবস ২০২৪`
- POEM - UNTOLD WORDS !
- Poems
- Poems
- Poems
- POEM - BY THE WAYS OF PARADISE
- Article - Zein lovers
- Poem - On the Open Eyelashes Shadow I Weave
- একগুচ্ছ কবিতা
- Poem - Centuries Later
- Poem - Mystery Remains
- অনুষ্ঠিত হল অরঙ্গাবাদ ব্রাইট ফিউচার অ্যাকাডেমির বার্ষিক অনুষ্ঠান
- সুতি পাবলিক স্কুল ও কোচিং সেন্টারের উদ্বোধন
- Poem - Your Hazelnut Eyes!!!!
- Poem - Life Is Melody
- একগুচ্ছ কবিতা
- Poem - Twilight
- Poem - Love in the Autumn Leaves
- রাজনীতিতে অসতের প্রবেশ,প্রতিবাদী না হলে সমূহ বিপদ
- রাজনীতিতে অসতের প্রবেশ,প্রতিবাদী না হলে সমূহ বিপদ
- রাজনীতিতে অসতের প্রবেশ,প্রতিবাদী না হলে সমূহ বিপদ
- Poem - Missing the Sky
- Poem - Missing the Sky
- Poem - The Philosophy of the Eyes
- Poem - Silence
- Poem - When the Pen Abandons You
- POEM - LEAVE
- দ্বিতীয়বারের জন্য হোয়াইট হাউসে ডোনাল্ড ট্র্যাম্প
- Poem - Centuries Later
- Poem - Mystery Remains
- POEM - UNTOLD WORDS !
- আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় মুর্শিদাবাদ সেন্টারে অনুষ্ঠিত হল `জন জাতীয় গৌরব দিবস ২০২৪`
- একগুচ্ছ কবিতা
- Poem - On the Open Eyelashes Shadow I Weave
- POEM - BY THE WAYS OF PARADISE
- Poems
- আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় মুর্শিদাবাদ সেন্টারে অনুষ্ঠিত হল `জন জাতীয় গৌরব দিবস ২০২৪`
- Poems
- Poems
- Article - Zein lovers
- আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় মুর্শিদাবাদ সেন্টারে অনুষ্ঠিত হল `জন জাতীয় গৌরব দিবস ২০২৪`
- রায়গঞ্জ কেন্দ্রে বিজেপির চমক? প্রচারে সিপিএম ত
- মালদায় পুকুর ভরাটের বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ মন্ত্রী সাধন পান্ডের
- কালিয়াচকে বোমের আঘাতে যখম দুই লিচু ব্যবসায়ী
- Poem - Occasional Poetry
- POEM - CELEBRATING POETRY
- সৌমেন্দু লাহিড়ী
সৌমেন্দু লাহিড়ীর কবিতা- `আর্জি` - অঙ্কিতা চ্যাটার্জী কলম
ন্যানো গ্রাম বিষ : কবি আত্মা ও কাব্য আত্মা - আহত সাংবাদিক
রাহুল গান্ধীর পাঁচগ্রামের জনসভা আহত এক সাংবাদিক - TO SOMETIMES, JUST SOMETIMES
- ইজাজ আহামেদ
বেকারত্বের গ্লানি - রায়গঞ্জে
মোড়ক উন্মোচনেই শব্দলিপি-র সশব্দ দৃপ্ত পদচারণ - খুন হওয়া বিজেপি কর্মীর মৃতদেহ নিয়ে শ্রীরূপার শোক মিছিল
- Poem - Oak Leaf
- আকাদেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখিকা মৈত্রেয়ী দেবী
- দীপা দাসমুন্সির দেওয়াল লিখন ইসলামপুর কংগ্রেসের