ব্রেকিং:
আরজি কর মেডিকেলে ২০০ কোটির দুরনীতি, একাধিক প্রভাবশালীর জোগ থাকার সম্ভাবনা নলপুরে বেলাইন সেকান্দ্রাবাদ-শালিমার এক্সপ্রেস চলতি মাসেই ২০ ডিগ্রির নীচে তাপমাত্রা, রয়েছে নিম্নচাপের সম্ভাবনাও আগ্রা- লখনউ এক্সপ্রেসওয়েতে দুর্ঘটনায় ৫ জনের মৃত্যু রায়গঞ্জের কুলিকে শিশুর প্রাণ বাচিয়ে ডুবে মৃত্যু তরুণের গাজোলে মাটি খুড়তে গিয়ে উদ্ধার ১৬টি রুপার মুদ্রা

বৃহস্পতিবার   ১৪ নভেম্বর ২০২৪   কার্তিক ৩০ ১৪৩১   ১৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

সর্বশেষ:
মুর্শিদাবাদের সুতিতে শুট আউট। CSK-তে যাচ্ছেন ঋষভ? সামনে এল বড় খবর
রাজনীতিতে অসতের প্রবেশ,প্রতিবাদী না হলে সমূহ বিপদ

রাজনীতিতে অসতের প্রবেশ,প্রতিবাদী না হলে সমূহ বিপদ

রাজনীতিতে অসতের প্রবেশ,

১০:২০ এএম, ৯ নভেম্বর ২০২৪ শনিবার

ভারতের মূল সুর  বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য আজ প্রশ্নের মুখে

ভারতের মূল সুর বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য আজ প্রশ্নের মুখে

ভারতের মূল সুর বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য আজ প্রশ্নের মুখে   

 

 মনিরুজ্জামান (শিক্ষক জঙ্গিপুর হাই স্কুল)            

ভারতীয় জীবন ও সংস্কৃতির মূল মন্ত্র হলো বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য । সম্প্রতি আমরা লক্ষ্য করছি এই মূলমন্ত্র কিছু উগ্র সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রনায়কদের দ্বারা লঙ্ঘিত হচ্ছে । কবির ভাষায় ভারতের অন্তরের মূল সুর ধ্বনিত হয়েছে "--নানা ভাষা নানা মত নানা পরিধান বিবিধের মাঝে দেখ মিলন মহান" । ভারত নামক তীর্থক্ষেত্রে শক, হুন, পাঠান, মোগল এক দেহে লীন হয়ে গিয়েছে । বিভিন্ন জনগোষ্ঠী তাদের স্বতন্ত্র কৃষ্টি-কালচার নিয়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রেখে বসবাস করে আসছে। আমাদের প্রথম পরিচয় আমরা ভারতীয় । বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে আমাদের গর্ব ও কম নয় । 

 

কিন্তু সমস্যা তখন দেখা যায় যখন গণতন্ত্রের চাবি উগ্র সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রনায়কদের হাতে চলে যায় । গোটা বিশ্বের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে এর সত্যতার সহজে উন্মোচিত হয় । যেমনি হিটলার, মুসোলিনি, গ্যারিবল্ডি, এরা মানবতার চরম অবক্ষয় ঘটেয়েছে । গত কয়েক বছর ধরে লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে ,ভারতের সংবিধান স্বীকৃত মিলন মেলার মিষ্টি সুর , কোথাও যেন অন্তর্হিত হচ্ছে । রাষ্ট্র যদি জাতীয়তা বোধ জাগ্রত করার পরিবর্তে মানুষে মানুষ বিদ্বেষ ছড়ায় তাহলেই মানবিক অবমূল্যায়ন শুরু হয় । দেশের অগ্রগতি ও পশ্চাৎপদতা নির্ভর করছে রাষ্ট্রের উপর । তবে অগ্রগতির স্বরূপটা এক এক জনের কাছে একেক রকম । পৃথিবী যখন এগিয়ে চলেছে তখন কেউ যদি প্রাচীন সংস্কৃতি নিয়ে এগোতে চায় তবে সেটা হবে মুর্খামি । বিজ্ঞানকে অস্বীকার করে অগ্রগতি কোনোভাবেই সম্ভব নয় । কোন রাষ্ট্রপ্রধান যদি একটি মন্দির, একটি স্ট্যাচু ও গরুর গোবর ও মূত্র নিয়ে গবেষণা করে ভাবে বিরাট কাজ করেছি তবে সে মূর্খের স্বর্গে বসবাস করছে ।

 

মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের পিছনে অনেকগুলো কারণ রয়েছে । তন্মধ্যে সবচেয়ে বড় কারন হলো ধর্মীয় সংকীর্ণতা । নিজের ধর্মের প্রতি অনুরাগ থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু তার পরিণতিতে পরও ধর্মের প্রতি বিদ্বেষের ফল হয় মারাত্মক । আমাদের দেশে এরকম ঘটনা বেশি ঘটে । দায়িত্বজ্ঞানহীন ও প্রকৃত ধর্মীয় বোধহীন কিছু ধর্মীয় নেতা সাধারণ মানুষের মধ্যে সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িকতা জাগিয়ে তোলে । ওইসব নেতা তাদের ব্যক্তিগত স্বার্থ সিদ্ধির জন্য এই ধরনের কাজ করে থাকে । তার ফল হয় মারাত্মক । মনে রাখতে হবে ধর্মীয় ভাইরাস কোভিড ১৯ এর চেয়েও ভয়ানক । ফলস্বরূপ গুজরাট দাঙ্গার বীভৎস রূপ আমাদের কাছে উন্মোচিত হয়েছে । সম্প্রতি দিল্লি দাঙ্গা বিশ্ববাসীকে হতবাক করে দিয়েছে । এছাড়া ভারতবর্ষের বিভিন্ন রাজ্যের প্রায়ই ছোটখাটো দাঙ্গার খবর পাওয়া যাচ্ছে । নিজের ধর্ম অপরে উপরে চাপিয়ে দেওয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে । কে কি খাবে ,কোন পোশাক পরিধান করবে ,কোন ভাষায় কথা বলবে ,কাকে বিয়ে করবে --এগুলো একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার ।রাষ্ট্রের এই ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করা সমীচীন নয় ।ধর্মের ষাঁড়েরা সাধারণ মানুষকে যেখানে-সেখানে পিটিয়ে মারছে । এক্ষেত্রে বেশিরভাগ ষাঁড়দের শিকার হচ্ছে মুসলিম ও দলিত সম্প্রদায়ের মানুষজন । উত্তর প্রদেশ বিহার মধ্যপ্রদেশ রাজস্থান এমনকি কর্নাটকে এই ধরনের ঘটনা বেশি ঘটছে । সরকারের প্রচ্ছন্ন মদত না থাকলে এতগুলো মানুষ মারা যেত না । মানুষকে পিটিয়ে মেরে, তার ভিডিও করে নেট দুনিয়ায় ছেড়ে দিচ্ছে তবুও তারা উপযুক্ত শাস্তি পাচ্ছে না । নিজের হাতে আইন তুলে নেওয়ার পরেও পুলিশের ভূমিকা আমাদের আহত করেছে । গরু কে কেন্দ্র করে সবচেয়ে বেশি এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে । গরুকে কেউ পূজো করতেই পারে, তাকে মা বলতেও পারে,Q1 তাতে কারো কোনো আপত্তি থাকার কথা নয় । কিন্তু গরুর মাংস খাওয়া নিয়ে যে ধরনের ঘটনা ঘটছে তা কোনভাবেই অভিপ্রেত নয়। ফ্রিজে মাংস থাকলে বা কারো ব্যাগে মাংস থাকলে তাকে নির্বিচারে হত্যা করা হচ্ছে, এটা কোন সভ্য সমাজে চলতে পারে না।

 

 

রাষ্ট্রের কাজ প্রতিটি নাগরিককে সুরক্ষা দেওয়া । সরকার কি পেরেছে সুরক্ষা দিতে ? বিজেপি শাসিত মণিপুরে দীর্ঘদিন ধরে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা চলছে। ইতিমধ্যে কয়েকশো মানুষ মারা গিয়েছে। প্রায় ৩০ হাজার মানুষ গৃহ ছাড়া ।ভারতের প্রধানমন্ত্রী সেখানে যাওয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি।উত্তরপ্রদেশ যেন প্রাচীন যুগে ফিরে গেছে । দলিতদের প্রতি অমানবিক অত্যাচার চরম হারে বেড়ে গিয়েছে । কাউকে ধর্ষন করে পুড়িয়ে দিচ্ছে, কাউকে পিটিয়ে হত্যা করছে ,রীতিমতো জঙ্গল রাজ চলছে । অপরদিকে আসামে প্রায় ১৯ লক্ষ মানুষ এনআরসির নামে অসহ্য কষ্টের মধ্যে দিন পার করছে । সরকার ইউএপিএ নামক একটি আইন তৈরি করেছে । হাজার হাজার কাশ্মীরি কে এই আইনে জেলে পুরেছে; এগুলো কি অমানবিক নয় ? যারা কৃষি বিল নিয়ে আন্দোলন করছে তাদের কেউওএই আইনে গ্রেফতার করা হচ্ছে । যে সমস্ত শিল্পী,সাহিত্যিক, সমাজকর্মী ,সাংবাদিক ,সরকারের অমানবিক কর্মসূচির সমালোচনা করছে তাদের কেউও এই আইনে গ্রেফতার করা হচ্ছে । ভারতবর্ষের বুদ্ধিজীবীদের বাকস্বাধীনতা কেড়ে নেয়া হয়েছে । সরকার সিবিআই , ইডি , এনআইএ , এর মত সংস্থাগুলোকে নিজের মতো করে কাজে লাগাচ্ছে । সিবিআই সম্পর্কে সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি লোধা মন্তব্য করেছিলেন "সিবিআই খাঁচায় বন্দী তোতা পাখি" । মানুষ সঠিক বিচার পাচ্ছে না । ভীম করে গাও ;গুজরাট, দিল্লির গণহত্যার তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়ার কদর্য রূপ আমরা দেখেছি । ইসরাত জাহান এর বিচার প্রক্রিয়া ও আমরা দেখেছি । ইউএপিএ ধারায় যে সমস্ত মানুষগুলোকে গ্রেপ্তার করছে তার বেশিরভাগই নির্দোষ । ১০০০০ জনকে গ্রেপ্তার করলে দোষ প্রমাণিত হয় মাত্র ২০০ জনের । অর্থাৎ 2%। । জাতীয় মানবাধিকার কমিশন কেউও সরকার নিয়ন্ত্রণ করছে । সরকারের সম্পদ কয়েকটি কর্পোরেট সংস্থার হাতে তুলে দিয়ে অর্থনৈতিক বৈষম্য তৈরী করা হয়েছে । সমস্ত নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম আকাশছোঁয়া । ৩৫ টাকা লিটারের পেট্রোল ১০০ টাকার দামের বেশি দামে কিনতে হচ্ছে । কয়েক জন মানুষ ব্যাংকের সমস্ত টাকা লুট করে বিদেশে পালিয়ে গেছে । তার ক্ষতিপূরণ দিতে হচ্ছে আপামর সাধারণ মানুষকে । ইজরাইল থেকে পেগাসাস এর সাহায্যে বিরোধী রাজনৈতিক নেতা ও সাংবাদিকদের ফোন হ্যাক করা হচ্ছে । সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত আজকে তার নিরপেক্ষতা হারিয়েছে । মানুষ যাবে কোথায় ? ইতিমধ্যে বিজেপি শাসিত কয়েকটি রাজ্যে ইউনিফর্ম সিভিল কোড অর্থাৎ অভিন্ন দেওয়ানি বিধি লাভ করা হয়েছে ।ভারতের মতো দেশে এই ধরনের আইন কোনোভাবে প্রযোজ্য নয়। এক্ষেত্রে বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য বিনষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল ।পারস্পারিক সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির যে মূল সুর তাকে বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করে দিতে চাইছে । আমাদের উদ্দেশ্য হবে unity in diversity অর্থাৎ বৈচিত্রের মধ্যে ভারত আত্মার অন্তরের যে ঐক্য ও সমন্বয়ের সুর নিহিত আছে তাকে ধারণ করায় হলো আমাদের মূল লক্ষ্য ।

 

           

 

০৮:৩৪ এএম, ৩০ জুন ২০২৪ রোববার

ভারতীয় রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্র ও পরিবারহীনতা

ভারতীয় রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্র ও পরিবারহীনতা

ভারতীয় রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্র ও পরিবারহীনতা 
মজিবুর রহমান, প্রধানশিক্ষক, কাবিলপুর হাইস্কুল 

       বিশ্বজুড়ে রাষ্ট্র পরিচালনায় রাজতন্ত্র ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। অষ্টাদশ শতাব্দীতে ব্রিটিশ শাসনের সূচনার মধ্য দিয়ে ভারতে রাজতন্ত্রের অবসান ঘটে। তবে স্বাধীন ভারতে কংগ্রেসের হাত ধরে রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্রের উত্থান ঘটতে দেখা যায়। বিগত সাড়ে সাত দশকে পরিবারতন্ত্র বেড়েছে বৈ কমেনি।যা একসময় ছিল একান্তই কংগ্রেসী ব্যাপার তা এখন বহু সংখ্যক দলের মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছে। বেশ কয়েকটি রাজ্যে পরিবারতন্ত্র রাজনীতিতে নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন করছে। পরিবারতন্ত্রের পাশাপাশি পরিবারকে পরিহার করে শুধুমাত্র ব্যক্তিগত স্তরেই রাজনীতিকে সীমাবদ্ধ রাখার একটা উল্লেখযোগ্য দিকও রয়েছে। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক ব্যক্তিটির রাজনীতির সঙ্গে তাঁর বৌ-বাচ্চাদের কোনো সম্পর্ক নেই।
        রাজনৈতিক মতাদর্শের সাথে পরিবারকে একদমই না জড়িয়ে দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতি করার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হলেন কমিউনিস্ট নেতা জ্যোতি বসু (১৯১৪-২০১০)। জ্যোতি বসুর পিতা চাননি তাঁর ব্যারিস্টার পুত্র আইনজীবী না হয়ে বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হোন। চল্লিশের দশকে অবিভক্ত বাংলা তথা ভারতে বামপন্থী রাজনীতির কোনো ভবিষ্যৎ ছিল না। কিন্তু মার্ক্সবাদী ভাবনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ব্যক্তিগত সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের কথা চিন্তা না করে জ্যোতি বসু কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত হন। পরবর্তীকালে সাড়ে তেইশ বছর পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং দেশের একজন অগ্ৰগণ্য কমিউনিস্ট নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। কিন্তু তাঁর রাজনৈতিক দর্শনের সাথে তাঁর সন্তানের কোনো সম্পর্ক থাকতে দেখা যায়নি। 'সর্বহারার নেতা' জ্যোতি বসুর পুত্র চন্দন বসু (১৯৫২-) শিল্পপতি হয়েছেন। পিতা 'নাস্তিক' হলেও পুত্র ভীষণ ঈশ্বর বিশ্বাসী, কালী ভক্ত।তাই তিনি আড়াই কেজি ওজনের সোনার খাঁড়া প্রণামী দেন। আরেক কমিউনিস্ট মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের (১৯৪৪-) সন্তানকেও কোনদিন রাজনৈতিক মঞ্চে অবস্থান করতে দেখা যায়নি। অনিল বিশ্বাস একজন দক্ষ সংগঠক ছিলেন। সিপিআই(এম)-এর রাজ্য সম্পাদক ও মুখপত্র গণশক্তির সম্পাদক হিসেবে অনিল বিশ্বাসের (১৯৪৪-২০০৬) অবদানের কথা আজও পার্টির অভ্যন্তরে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হয়। তাঁকে মাঝেমধ্যেই তৃণমূল কংগ্রেস সুপ্রিমো মমতা ব্যানার্জি সম্পর্কে অত্যন্ত কড়া মন্তব্য করতে শোনা গেছে। কিন্তু অনিল-তনয়া অধ্যাপক অজন্তা বিশ্বাস তৃণমূলের মুখপত্রে মমতা ব্যানার্জির প্রশংসা লিখতে দ্বিধাবোধ করেননি। অবশ্য এর পরিণতিতে তাঁর সঙ্গে সিপিএমের সম্পর্ক শেষ হয়ে গেছে।
        ভারতীয় রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্রের উদ্ভব হয়েছে নেহরু-গান্ধী পরিবার থেকে। এলাহাবাদের প্রখ্যাত আইনজীবী মতিলাল নেহরু (১৮৬১-১৯৩১) ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের একজন বিশিষ্ট নেতা ছিলেন। তিনি ১৯১৯ ও ১৯২৮ সালে কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন। পুত্র জওহরলাল (১৮৮৯-১৯৬৪) ও কন্যা বিজয়লক্ষ্মী (১৯০০-১৯৯০) প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা শেষ করে রাজনীতিতে যোগ দেন। ১৯২৯ সালে কংগ্রেস সভাপতির পদে জওহরলাল মতিলালের স্থলাভিসিক্ত হন। পরে স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন এবং আমৃত্যু ওই পদে বহাল থাকেন। বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিত গণপরিষদের সদস্য ছিলেন। তিনি সোভিয়েত ইউনিয়ন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, আয়ারল্যান্ড ও স্পেনে ভারতের রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। রাষ্ট্রসঙ্ঘে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেন। মহারাষ্ট্রের রাজ্যপাল ও লোকসভার সদস্য ছিলেন। জওহরলাল নেহরুর পত্নী কমলা নেহরুও (১৮৯৯-১৯৩৬) স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে কারাবাস ভোগ করেন। জওহরলাল ও কমলার কন্যা ইন্দিরা প্রিয়দর্শিনী (১৯১৭-১৯৮৪) ১৯৪২ সালে ফিরোজ গান্ধীর (১৯১২-১৯৬০) সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে স্বামীর পদবী গ্ৰহণ করেন। ফিরোজ গান্ধীও রাজনীতি করতেন, স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে কারাবাস ভোগ করেন এবং ১৯৫২ ও '৫৭ সালে লোকসভার সাংসদ নির্বাচিত হন। এই রকম একটা গৃহ পরিবেশের মধ্যে বেড়ে ওঠা ইন্দিরা অন্য কোনো পেশায় নিয়োজিত না হয়ে রাজনীতিতে চলে আসেন। ১৯৫৯ সালে তিনি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভানেত্রী নির্বাচিত হন। ১৯৬৪ সালে জওহরলাল নেহরুর জীবনাবসানের অব্যবহিত পরেই তাঁকে রাজ্যসভার সাংসদ পদ প্রদান করা হয় এবং তিনি লালবাহাদুর শাস্ত্রীর মন্ত্রিসভায় তথ্য ও সম্প্রচার দপ্তরের মন্ত্রী নিযুক্ত হন। পরে পনের বছর (২৪.১.৬৬-২৪.৩.৭৭ ও ৯.৩.৮০-৩১.১০.৮৪) প্রধানমন্ত্রীর পদ অলংকৃত করেন। ফিরোজ-ইন্দিরার দুই পুত্র রাজীব (১৯৪৪-১৯৯১) ও সঞ্জয়ও (১৯৪৬-১৯৮০) পারিবারিক ঐতিহ্য বজায় রেখে রাজনীতিতে যোগ দেন। প্রথমে আসেন সঞ্জয় গান্ধী। তিনি ১৯৮০ সালের লোকসভা নির্বাচনে আমেথি কেন্দ্র থেকে সাংসদ নির্বাচিত হন।ওই বছর ২৩শে জুন কপ্টার দুর্ঘটনায় সঞ্জয়ের মৃত্যু হলে ইন্দিরা গান্ধী তাঁর রাজনৈতিক উত্তরসূরি হিসেবে রাজীব গান্ধীকে নিয়ে আসেন। রাজনীতিতে যোগদানের আগে তিনি ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের বিমানচালক ছিলেন। ১৯৮১ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে আমেথি কেন্দ্র থেকে উপনির্বাচনে জয়লাভ করে সাংসদ হন। ১৯৮৪ সালের ৩১শে অক্টোবর ইন্দিরা গান্ধী নিহত হলে রাজীব গান্ধী ৪০ বছর বয়সে ৩ বছরের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা নিয়ে দেশের প্রধানমন্ত্রীর কার্যভার গ্রহণ করেন। ওই বছরই ডিসেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত লোকসভা নির্বাচনে তাঁর নেতৃত্বে কংগ্রেস রেকর্ড সংখ্যক ৪১১টি আসনে জয়লাভ করে এবং প্রত্যাশিতভাবেই প্রধানমন্ত্রীর পদে তিনি পুনর্নির্বাচিত হন। ১৯৮৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে তাঁর দল সরকার গঠন করতে ব্যর্থ হয় এবং ১৯৯১ সালের ২১শে মে লোকসভা নির্বাচনের প্রচার চলাকালীন তামিলনাড়ুর শ্রীপেরামবুদুরে বোমা বিস্ফোরণে তিনি নিহত হন। রাজীব গান্ধীর নিহত হবার পর কিছুদিনের জন্য ভারতীয় রাজনীতিতে নেহরু-গান্ধী পরিবারের কোনো প্রতিনিধি ছিল না। ১৯৯৮ সালে রাজীবের ইতালীয় পত্নী সোনিয়া গান্ধী (১৯৪৬-) কংগ্রেসের সভানেত্রী রূপে রাজনীতিতে পদার্পণ করেন। তিনি ১৯৯৯ সাল থেকে সাংসদ রয়েছেন।রাজীব-সোনিয়ার পুত্র রাহুল গান্ধীও (১৯৭০-) কংগ্রেসের একজন অতি গুরুত্বপূর্ণ নেতা। তিনি ২০০৪ সাল থেকে লোকসভার সাংসদ আছেন। তাঁর বোন প্রিয়ঙ্কা গান্ধীও (১৯৭২-) এখন লোকসভার সদস্য হওয়ার পথে। সঞ্জয় গান্ধীর স্ত্রী মানেকা গান্ধী (১৯৫৬-) একাধিকবার সাংসদ ও মন্ত্রী হয়েছেন। পুত্র বরুণ গান্ধী (১৯৮০-) ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত লোকসভার সাংসদ ছিলেন। তাঁরা মা-ছেলে অবশ্য কংগ্রেস নয়, বিজেপি করেন। কংগ্রেস কোনদিনই নেহরু-গান্ধী পরিবারের প্রভাব কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করেনি। দু'একজন নেতা চেষ্টা করলেও সফল হননি, হয়তো দল ছেড়ে চলে গেছেন অথবা আলাদা দল গঠন করেছেন। কিন্তু ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস জওহরলাল নেহরুর উত্তর পুরুষদের নিয়ন্ত্রণেই থেকেছে। 
      ১৯৪৯ সালে স্থাপিত দ্রাবিড় মুনেত্র কাজগম (ডিএমকে)-এর ১৯৬৯ সাল থেকে আমৃত্যু সভাপতি ছিলেন এম করুণানিধি (১৯২৪-২০১৮)। করুণানিধি পাঁচ দফায় কুড়ি বছর তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পুত্র এম কে স্ট্যালিন (১৯৫৩-) ও কন্যা কানিমোঝি (১৯৬৮-) পিতার রাজনৈতিক উত্তরাধিকার বহন করছেন।কানিমোঝি দুবার করে রাজ্যসভা ও লোকসভার সাংসদ নির্বাচিত হয়েছেন। ১৮তম লোকসভায় তিনি ডিএমকে-র দলনেত্রী।করুণানিধির জীবনাবসানের পর দলের সভাপতি হন স্ট্যালিন। চেন্নাইয়ের মেয়র, বাবার মন্ত্রিসভায় মন্ত্রী, উপমুখ্যমন্ত্রী, বিধানসভার বিরোধী দলনেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করার পর ২০২১-এর মে মাস থেকে মুখ্যমন্ত্রী রয়েছেন। তাঁর পুত্র উদয়নিধি স্ট্যালিন (১৯৭৭-) চলচ্চিত্রের জগৎ ছেড়ে রাজনীতিতে প্রবেশ করেছেন এবং ২০২২-এর ডিসেম্বরে থেকে পিতার মন্ত্রিসভায় যুব কল্যাণ ও ক্রীড়া উন্নয়ন দপ্তরের মন্ত্রী নিযুক্ত হয়েছেন।
       বালাসাহেব ঠাকরে (১৯২৬-২০১২) ১৯৬৬ সালে মহারাষ্ট্রকেন্দ্রিক রাজনৈতিক দল শিবসেনা গঠন করেন। তিনি অবশ্য কখনও বিধায়ক অথবা সাংসদ হননি। তিনি 'কিং মেকার' হিসেবে 'রিমোট কন্ট্রোল' চালাতে পছন্দ করতেন। তাঁর ছেলে উদ্ধব ঠাকরে (১৯৬০-) ২০১৯-এর নভেম্বর থেকে ২০২২-এর জুন পর্যন্ত মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। সেই মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন তাঁর পুত্র আদিত্য ঠাকরে (১৯৯০-)। 
      জনতা দলের নেতা মুলায়ম সিং যাদব (১৯৩৯-২০২২) ১৯৯২ সালে সমাজবাদী পার্টি গঠন করেন। তিনি তিন দফায় সাত বছর উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী ও দুই দফায় দুই বছর দেশের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ছিলেন। ২০০০ সালে লোকসভার সাংসদ নির্বাচিত হওয়ার মধ্য দিয়ে তাঁর পুত্র অখিলেশ যাদবের (১৯৭৩-) রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শুরু হয়। তিনি ২০১২-'১৭ উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। বর্তমানে সমাজবাদী পার্টির সর্বভারতীয় সভাপতি। অখিলেশের স্ত্রী ডিম্পল যাদব (১৯৭৮-) একাধিকবার সাংসদ নির্বাচিত হয়েছেন।
     জনতা দলের নেতা লালু প্রসাদ যাদব (১৯৪৮-) ১৯৯৭ সালে রাষ্ট্রীয় জনতা দল গঠন করেন। ওই সময়ে আইনি জটিলতার কারণে লালু প্রসাদকে বিহারের মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ার ছাড়তে হয়। তখন তিনি তাঁর ৯ সন্তানের জননী রাবড়ি দেবীকে (১৯৫৫-) ওই পদে বসিয়ে দেন। রাবড়ি দেবী ২০০৫ সাল পর্যন্ত মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। এখন তাঁদের পুত্র তেজস্বী যাদব (১৯৮৯-) আরজেডি-র সভাপতি ও বিধায়ক। ২০২২-এর আগস্ট থেকে ২০২৪-এর জানুয়ারি পর্যন্ত তিনি উপ-মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন।
     মমতা ব্যানার্জি (১৯৫৫) ১৯৮৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের টিকিটে সাংসদ নির্বাচিত হন। ১৯৯৮ সালে তিনি তৃণমূল কংগ্রেস গঠন করেন। ২০১১ সাল থেকে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী রয়েছেন। তাঁর ভাইপো অভিষেক ব্যানার্জি (১৯৮৭-) ২০১৪ সাল থেকে লোকসভার সাংসদ রয়েছেন। ২০২১ সাল থেকে দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তৃণমূল কংগ্রেস পিসির 'নেতৃত্বে' ও ভাইপোর 'সেনাপতিত্বে' এগিয়ে চলেছে।
     রাজনীতি একটি বহুমাত্রিক বৃহৎ বিষয়। এখানে বিভিন্ন ধরনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সাধন করার সুযোগ থাকে। রাজনীতি 'দেশোদ্ধার' করার একটি শক্তিশালী মাধ্যম। নেতাকর্মীরা 'ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ান।' কিছু পেতে নয়, বরং কিছু দিতেই রাজনীতিতে আসার কথা। সম্প্রতি এই ভাবনায় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এসেছে। রাজনীতি জনসেবা করার নেশা থেকে ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার পেশা হয়ে উঠছে। এখন রাজনীতিতে অর্থ, ক্ষমতা, প্রচার সবকিছুই প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যাচ্ছে। রাজনীতি সকল চাকরির সেরা চাকরিতে অথবা সকল ব্যবসার সেরা ব্যবসাতে পরিণত হচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই রাজনীতির মোহ কাটিয়ে ওঠা কঠিন হয়ে পড়ছে। তাই রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্র জাঁকিয়ে বসতে দেখা যাচ্ছে।

১১:৩৫ এএম, ২৫ জুন ২০২৪ মঙ্গলবার

শাসকের সঙ্গে সংঘাত ও বিচারালয়ের বাড়াবাড়ি

শাসকের সঙ্গে সংঘাত ও বিচারালয়ের বাড়াবাড়ি

শাসকের সঙ্গে সংঘাত ও বিচারালয়ের বাড়াবাড়ি

মজিবুর রহমান

 

     পশ্চিমবঙ্গে শাসকের সঙ্গে আদালতের সংঘাত লেগেছে। অন্তত তিন বছর ধরে এই লড়াই জোরকদমে চলছে। প্রশাসনিক হেডকোয়ার্টার নবান্ন আর কলকাতা হাইকোর্টের কাজিয়া সুপ্রিম কোর্টে গিয়ে জমা পড়ছে। দুশ্চিন্তা ও দুর্ভাবনার শিকার হচ্ছে রাজ্যের লাখ লাখ সাধারণ মানুষ। সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি হচ্ছে।সাংঘাতিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিক্ষার মতো খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি ক্ষেত্র। এই পরিস্থিতির জন্য সরকার ও আদালত উভয়েরই দায় রয়েছে। কেউই সমস্যার সমাধানে আন্তরিক নয়। বরং সমস্যাকে জটিল থেকে জটিলতর ও দীর্ঘমেয়াদি করা হয়। এখানে তিনটি বিচারবিভাগীয় নির্দেশ ও সেগুলোর অভিঘাত নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করা হল।

      বিগত কয়েক বছরে রাজ্যের সরকারি বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী নিয়োগ প্রক্রিয়ায় নানান ধরনের নিয়ম ভঙ্গের ঘটনা ঘটেছে। অজ্ঞতাবশত বা অনিচ্ছাকৃত ভুল নয় , বেশ পরিকল্পনা করে নিয়োগ প্রক্রিয়ার বিভিন্ন স্তরে বিভ্রাট ঘটানো হয়েছে। স্বজন পোষণ ও বিশাল অঙ্কের আর্থিক লেনদেন হয়েছে।পুরো ঘটনাটা একটা প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন সাংসদ, বিধায়ক, মন্ত্রী, সরকারি আধিকারিক ও শাসক দলের নেতাকর্মীরা। গত দুই বছরে ২৫-৩০ জনকে ধরা হয়েছে। ২০১৬ সালের স্কুল সার্ভিস কমিশনের প্যানেলে উত্তরপত্র তথা অপটিক্যাল মার্ক রেকগনিশন (ও এম আর) শীট বিকৃতি, সিরিয়াল ব্রেক, প্যানেলের বাইরে থেকে নিয়োগ, সুপার নিউমেরিক পোস্ট সৃষ্টি সহ বেশ কয়েক রকমের অনিয়মের সন্ধান পাওয়া গেছে। ওই প্যানেল থেকে ২৬ হাজার শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী নিযুক্ত হন। তদন্তের স্বার্থে সকলের নথিপত্রের হার্ডকপি জেলায় জেলায় ডিআই অফিসে অথবা কলকাতায় মধ্যশিক্ষা পর্ষদের অফিসে জমা করা হয়। ফোনের মাধ্যমেও তথ্য প্রদান করা হয়। সবকিছু যাচাই করে দেখা যায়, নিয়ম ভঙ্গ করে নিয়োগপত্র পাওয়া শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীর সংখ্যা আট হাজারের কম আর নিয়ম মেনে নিযুক্ত হয়েছেন আঠারো হাজারের বেশি। অর্থাৎ বৈধ শিক্ষকের সংখ্যা অবৈধ শিক্ষকের থেকে অনেকটাই বেশি। কাঁকড় বেছে ফেলার পর খাদ্য শস্য ভক্ষণ করাই সাধারণ নিয়ম। জমি থেকে আগাছা পরিষ্কার করে আমরা সবাই ফসল রক্ষা করি। আগাছার সাথে ফসল কেটে ফেলি না। কিন্তু কলকাতা উচ্চ আদালতের ডিভিশন বেঞ্চ নিয়োগ মামলার রায় দিতে গিয়ে আগাছার সাথে ফসলও কেটে ফেলার নিদান দিয়েছে।কাঁকড় না বেছে সমস্ত শস্য কণা ডাস্টবিনে ফেলার ফতোয়া জারি করেছে। ২০১৬ সালের শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীদের সব প্যানেল বাতিল। 'ঢাকি সমেত বিসর্জন'।সকলের চাকরি ক্যানসেলড। এটা কোনো বিচার হল? ন্যায়বিচারের কোনো উপাদান কি এই রায়ের মধ্যে রয়েছে? বৈধ ও অবৈধ ভাবে নিযুক্ত উভয়েরই এক পরিণতি! মুড়ি-মিছরির এক দর! ডিভিশন বেঞ্চ সাফাই দিয়েছ, বারবার বলা সত্ত্বেও নাকি নিয়োগ প্রক্রিয়ার দুই প্রধান সংস্থা স্কুল সার্ভিস কমিশন ও মধ্যশিক্ষা পর্ষদ আদালতের কাছে বৈধ ও অবৈধ কর্মপ্রার্থীদের তালিকা জমা দেয়নি।তাই আসল ও নকলকে আলাদা করা যায়নি।কিন্তু প্রশ্ন হল, কমিশন ও পর্ষদ ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করেনি বলে বৈধ চাকরিজীবীরা বরখাস্ত হয়ে যাবেন? যারা আদালতের সঙ্গে সহযোগিতা করেনি আদালত তাদের শাস্তি দিক। তাদের বাধ্য করুক প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ করতে। কমিশন ও পর্ষদের দু'চারজন আধিকারিককে বাগে আনতে না পেরে হাজার হাজার চাকরিজীবীকে ব্যতিব্যস্ত করার কোনো মানে হয়? আজকের দিনে একটা সরকারি চাকরি পাওয়া 'ভগবানের সাক্ষাৎ' পাওয়ার সমান! অথচ বৈধভাবে অর্জন করা চাকরিকে কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। ২০১৬ সালের প্যানেলে এমন অনেকেই আছেন যাঁরা ২০১১ সালের প্যানেলের চাকরি ছেড়ে এসেছেন। মাদ্রাসা সার্ভিস কমিশনের প্যানেল থেকে পাওয়া চাকরি ছেড়ে এসেছেন।অন্য কোনো পেশার চাকরি ছেড়ে এসেছেন। অর্থাৎ এঁরা একাধিকবার সফলভাবে যোগ্যতার প্রমাণ দিয়ে চাকরি করছিলেন।আদালত কোনো বাছবিচার না করে সকলকেই বাতিল করে দিল। ভেবে দেখা হল না, একটি চাকরি একটি নিম্নবিত্ত অথবা মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য কত গুরুত্বপূর্ণ! চাকরি করার সুবাদে ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নিয়ে বহুজন গাড়ি বাড়ি করেছেন। বেতন থেকে ঋণের কিস্তি মেটানো হয়। হঠাৎ বেতন বন্ধ হলে তাঁরা কিভাবে ঋণ পরিশোধ করবেন? সুদ সহ বেতন ফেরতের নির্দেশ আরও মারাত্মক।ক'জন এই নির্দেশ পালন করতে পারবেন, সন্দেহ আছে। অনেকেই ভিটেমাটি ছেড়ে পালাবেন। আত্মহননের পথ বেছে নিতে বাধ্য হবেন। একসঙ্গে এতজন শিক্ষক চাকরিচ্যুত হলে স্কুলগুলোর অবস্থা কী হবে কেউ কি ভেবে দেখেছে? এখন রাজ্যের অধিকাংশ স্কুলে শিক্ষার্থীর তুলনায় শিক্ষকের সংখ্যা অনেক কম। স্কুল ফান্ড থেকে যৎসামান্য পারিশ্রমিকের বিনিময়ে চুক্তিভিত্তিক অস্থায়ী শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী নিয়োগ করে জোড়াতালি দিয়ে চলছে। এই মুহূর্তে অনেক স্কুলে ২০১৬ সালের প্যানেলের শিক্ষকই বেশি। একসঙ্গে অর্ধেক শিক্ষক বিদায় নিলে স্কুলগুলো চলবে কী করে! নতুন নিয়োগের ব্যাপারে কোর্টের কোনো কড়া নির্দেশনা নেই, শুধু বাতিলের বেলায় বড় বড় বক্তব্য! সরকারি স্কুল ছেড়ে মেধাবী ও আর্থিক সঙ্গতি সম্পন্ন পরিবারের ছেলেমেয়েরা সব প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে চলে যাচ্ছে। শিক্ষার বেসরকারিকরণ ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যেই কি কোনো বৃহত্তর ষড়যন্ত্র চলছে?

       মুর্শিদাবাদ জেলার একটি হাইস্কুলের একজন প্রধানশিক্ষক স্কুল সার্ভিস কমিশনের সুপারিশ পত্র ও মধ্যশিক্ষা পর্ষদের নিয়োগপত্র জাল করে তাঁর ছেলেকে নিজের স্কুলেই চাকরিতে ঢোকান। কোর্টের নির্দেশে সিআইডি তদন্ত করে। অভিযুক্ত পিতা-পুত্র ও দুজন শিক্ষা আধিকারিক কারাবাস ভোগ করেন। এসব ২০২২-২৩ সালের ঘটনা।এই নিয়োগ কেলেঙ্কারির প্রেক্ষাপটে এবছর মে মাসের দ্বিতীয়ার্ধে রাজ্যের সমস্ত হাইস্কুলের সকল শিক্ষক-শিক্ষিকার নিয়োগ সংক্রান্ত তথ্য পোর্টালে আপলোড করার নির্দেশ দেওয়া হয়। হার্ডকপি ডিআই অফিসে জমা করতে বলা হয়। নথিপত্রে শিক্ষকদের সেল্ফ অ্যাটেসটেড করতে বলা হয়।এই কাজ করার জন্য স্কুলগুলো এক সপ্তাহের মতো সময় পায়। তখন রাজ্যে গরমের ছুটি ও লোকসভা নির্বাচন চলছিল।গ্ৰীষ্মাবকাশে অনেকেই চিকিৎসা করাতে অথবা ঘুরতে ভিন রাজ্যে বা বিদেশে যান।একটা পুরনো ঘটনায় দীর্ঘাবকাশের মধ্যে এমন জরুরি ভিত্তিতে নথিপত্র চাওয়ার কোনো যুক্তি থাকতে পারে না। এই ধরনের আকস্মিক নির্দেশে অফিস আদালতের স্বেচ্ছাচারী মানসিকতাই প্রকাশ পায়।পশ্চিমবঙ্গে এখন দশ হাজার হাইস্কুলে দেড় লাখ শিক্ষক আছেন। মাত্র একজন শিক্ষকের নিয়োগের ক্ষেত্রে গুরুতর জালিয়াতির অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে।কারা এর সঙ্গে জড়িত তাও জানা গেছে।আইন অনুযায়ী তাদের যত কড়া শাস্তি দেওয়া যায় দেওয়া হোক। কিন্তু একটা স্কুলের একজন শিক্ষকের অপরাধের জন্য রাজ্যের হাজার হাজার স্কুলের লক্ষাধিক শিক্ষককে তদন্তের আওতায় টেনে আনার কোনো মানে হয়? একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনার জন্য এখন সবাইকেই সন্দেহ করতে হবে? বিড়ম্বনায় ফেলতে হবে? বিশ-ত্রিশ বছর চাকরি করার পর আবার নথিপত্র দেখাতে হবে? মশা মারতে কামান দাগা হচ্ছে!

       গত ২২শে মে কলকাতা হাইকোর্টের একটি ডিভিশন বেঞ্চ ২০১০ সালের পর থেকে রাজ্য সরকারের প্রদান করা সমস্ত ওবিসি সার্টিফিকেট বাতিল বলে রায় দিয়েছে। ২০১১ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বর্তমান রাজ্য সরকারের আমলে প্রায় পাঁচ লক্ষ ওবিসি সার্টিফিকেট ইস্যু করা হয়েছে। হাইকোর্ট এগুলোকে বাতিল ঘোষণা করেছে। ইতিমধ্যে এই সার্টিফিকেট ব্যবহার করে যে সুবিধা ভোগ করা হয়েছে তার ওপর কোনো নেতিবাচক প্রভাব না পড়লেও পরবর্তীতে অনুরূপ ছাড় আর পাওয়া যাবে না। রায়ে বলা হয়েছে, ১৯৯৩ সালের অনগ্ৰসর শ্রেণী কমিশন আইন অনুযায়ী ওবিসি'র তালিকা তৈরি করতে হবে। ঘটনা হল, ১৯৯৩ সালের আইন অনুযায়ী ২০০৯ সালে কিছু জনগোষ্ঠীকে ওবিসি হিসেবে চিহ্নিত করা হয় এবং তাদের জন্য শিক্ষা ও চাকরিতে সংরক্ষণ চালু করা হয়।এই জনগোষ্ঠীর অধিকাংশই ছিল মুসলমান। ২০১২ সালে আরেকটি আইন তৈরি করে অন্যান্য অনগ্ৰসর শ্রেণীর তালিকায় আরও কিছু জনগোষ্ঠীকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।এদেরও অধিকাংশই মুসলমান। ওবিসি'র তালিকায় ধাপে ধাপে জনগোষ্ঠী সংযোজন একটি স্বাভাবিক ঘটনা।ওবিসি'র তালিকায় জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও ওবিসি'র জন্য সংরক্ষণ কিন্তু বাড়েনি। সংরক্ষণের হার বাড়েনি বলে ওবিসি'র সুবিধাভোগীদের মধ্যে শুধুমাত্র প্রতিযোগিতা তীব্রতর হয়েছে।বিষয়টি এভাবে দেখা যেতে পারে: একটি ওবিসি সংরক্ষিত পদের জন্য ২০১২ সালের আগে হয়ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগ পেত পাঁচটি জনগোষ্ঠী, এখন পায় সাতটি। এছাড়া এর আর কোনো তাৎপর্য নেই। আদালত ২০১০ সালের পরের সমস্ত ওবিসি শংসাপত্র বাতিল করলেও ২০১২ সালের যে আইনের ভিত্তিতে শংসাপত্রগুলো প্রদান করা হয়েছিল সেই আইনকে কিন্তু বাতিল করা হয়নি। ২০১২ সালের আইন যদি অসাংবিধানিক না হয় তবে সেই আইন অনুযায়ী ইস্যু করা সার্টিফিকেট কেন বাতিল হবে? ২০১২ সালের আইন যদি বেআইনি না হয় তবে ১৯৯৩ সালের আইনকে কেন ভিত্তিভূমি ধরতে হবে? একই বিষয়ে যদি একাধিক আইন থাকে তবে তো সর্বশেষ আইনকেই অগ্ৰাধিকার দেওয়ার কথা।এক খোঁচাতেই পাঁচ লাখ মানুষের সার্টিফিকেট ক্যানসেল করে দেওয়া হল। কিন্তু ভেবে দেখা হল কি ওই সার্টিফিকেট পেতে কী পরিমাণ কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে? কত সাপোর্টিং ডকুমেন্ট সংগ্ৰহ করতে হয়েছে? হঠাৎ করে এত সংখ্যক সার্টিফিকেট বাতিল হওয়ার ফলে অনেক সমস্যা দেখা দিতে পারে। চাকরিতে যে 'হান্ড্রেড পয়েন্ট রোস্টার' অনুসরণ করা হয় তাতে ওবিসি'র জন্য সতের শতাংশ সংরক্ষণ থাকে।বিগত বারো-চোদ্দো বছরের সমস্ত সার্টিফিকেট বাতিল হবার ফলে সংরক্ষিত আসনে প্রয়োজনীয় সংখ্যক কর্মপ্রার্থী পাওয়া কঠিন হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ওবিসি শিক্ষার্থীদের জন্য সংরক্ষিত আসন কোনভাবেই পূরণ হবে না। ওবিসি'দের জন্য যে ছাত্র বৃত্তি রয়েছে তাতে কেউ আবেদনকারী হতে পারবে না। তফসিলি জাতি ও তফসিলি জনজাতির সঙ্গে অন্যান্য অনগ্ৰসর শ্রেণীর আর্থ-সামাজিক পশ্চাৎপদতার দিক থেকে বিশেষ পার্থক্য নেই। ফারাক যেটুকু আছে তা ধর্মীয় পরিচয়ে। এস সি-এস টি'রা অধিকাংশই হিন্দু আর ওবিসি'রা অধিকাংশই মুসলমান।দুর্ভাগ্যবশত, স্বাধীনতার সাড়ে সাত দশক পরে ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের অঙ্গরাজ্য পশ্চিমবঙ্গে মানুষের ধর্মীয় পরিচয়কে প্রাধান্য দিয়ে ওবিসি সার্টিফিকেট বাতিল করছে বিচারালয়। বিচারের বাণী কি বৈষম্যমূলক হয়ে যাচ্ছে না? আদালত সাধারণ মানুষের ভরসার জায়গা।সেই জায়গা থেকেই বারবার ধাক্কা খেয়ে মানুষ আজ বিভ্রান্ত, বিপন্ন।

১১:৩৩ এএম, ২৫ জুন ২০২৪ মঙ্গলবার

ভারতীয় সংবিধানের ৩০ নং ধারা ও ধর্মনিরপেক্ষ আমরা

ভারতীয় সংবিধানের ৩০ নং ধারা ও ধর্মনিরপেক্ষ আমরা

ভারতীয় সংবিধানের ৩০ নং ধারা ও ধর্মনিরপেক্ষ আমরা

খগেন্দ্রনাথ অধিকারী

 

 আজ থেকে পৌনে একশ বছর আগে ১৯৩৩ সালের জার্মান সংসদের নির্বাচনে এদেশের নরেন্দ্র মোদীর বি. জে. পি পার্টির মত হিটলারের নাৎসী পার্টি নিরুঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলেও একক গরিষ্ঠতা পান এবং তার ভিত্তিতে, জোর জবরদস্তি করে ও ভয় ভীতি দেখিয়ে ১৯৩৫ সালে ১৫ই সেপ্টেম্বর ন্যুরেমবার্গ আইন পাশ করেন। এই আইনের উদ্দেশ্য ছিল উগ্র ইহুদি বিদ্বেষ ছড়িয়ে ইহুদিদেরকে জার্মানী থেকে নিশ্চিহ্ন করা এবং আর্য রক্তের বিশুদ্ধতার নামে উগ্র জার্মান আধিপত্যবাদ প্রতিষ্ঠা করা। ঠিক একই কায়দায় নরেন্দ্র মোদী ও তাঁর নিরঙ্কুশ সংখ্যা গরিষ্ঠতাহীন বি. জে. পি পার্টি ২০২৪ এর লোকসভা নির্বাচনের পরে উগ্র হিন্দু মৌলবাদের ধ্বজা উড়িয়ে অশোক--আকবর--দারাশিকো--বিবেকানন্দ--রবীন্দ্রনাথের দেশে বহুত্ববাদী সংস্কৃতির আদর্শকে পদদলিত করে মুসলিম--খৃশ্চান--বৌদ্ধ--জৈন নির্বিশেষে সংখ্যালঘু মানুষদেরকে নিশ্চিহ্ন করার তথা ভারতকে একটি হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করার চক্রান্তে লিপ্ত আছে। এঁদের আওয়াজ হোল হিন্দী--হিন্দু--হিন্দুস্থান। অর্থাৎ এদেশের রাষ্ট্রভাষা হবে হিন্দি, এদেশের জাতি হবে হিন্দু, এদেশের নাম হবে হিন্দুস্থান।

এই লক্ষ্যকে মাথায় রেখে দেশজুড়ে বি. জে. পি উল্লিখিত ৩০ নং ধারাকে কেন্দ্র করে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়াচ্ছে। উল্লেখ্য যে ১৯৭৬ সালে ৪২ তম সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে ভারতবর্ষকে সংবিধানের প্রস্তাবনায় একটি ধর্মনিরপেক্ষ বা "Secular" দেশ হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু এই সংবিধান সংশোধনের বহু আগে থেকেই, অর্থাৎ ১৯৫০ সালের ২৬শে জানুয়ারী সংবিধান চালুর মুহূর্ত থেকেই ভারতবর্ষ হোল একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশ। প্রকাশ থাকে যে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নে ভারতের প্রথম রাষ্ট্রদূত ছিলেন ডঃ রাধাকৃষ্ণান, যিনি ছিলেন কমরেড যোসেফ স্ট্যালিনের খুবই গুণগ্রাহী। তিনি দেখেছিলেন যে সাম্রাজ্যবাদী দুনিয়া যতই কুৎসা করুক যে কমিউনিস্টরা ধর্ম মানে না, বাস্তবে ১৯৩৬ সালের স্ট্যালিন সংবিধানে সকল মানুষের ধর্মাচরণের অধিকারকে স্বীকৃতি জানানো হয়েছিল। বিশেষ কোন ধর্মকে আলাদা ধর্ম হিসাবে স্বীকার করা হয়নি। তবে ধর্মাচরণের অধিকারের পাশাপাশি সেখানে ধর্মের বিরুদ্ধে প্রচারের অধিকারও স্বীকৃত হয়। এই সংবিধানের ১২৪ নং ধারার ভাষায় "In order to ensure to citizens freedom of conscince, the church in the u.s.s.r is separated from the state, and the school from the church. Freedom of riligious worship and freedom of antireligious propaganda is recognized for all the citizens."

আমাদের দেশের সংবিধানে ধর্মাচরণের বিরুদ্ধে প্রচারের অধিকার স্বীকৃত হয়নি। তার মূল কারণ হোল আমাদের দেশের বহুত্ববাদী সংস্কৃতির সুর হোল অধ্যাত্মবাদ, ভোগবাদ বা বস্তুতান্ত্রিকতাবাদ নয়। চার্বাকের মত ভোগবাদী দার্শনিক যার মূল কথা ছিল "যাবৎ জীবেৎ সুখম্‌ জীবেৎ, ঋনং কৃত্বা ঘৃতম পিবেৎ," -- জন্মালেও, এটা ছিল আমাদের সংস্কৃতির মূল সুরের একটি ব্যতিক্রম মাত্র: আসল সুর হোল আধ্যাত্মবাদ। এই সুরের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে আমাদের সংবিধানের মধ্যে ২৫, ২৬ ও ৩০ নং ধারায় ধর্মাচরণের অধিকার স্বীকৃত হয়েছে। প্রকাশ থাকে যে দেশ যখন সাভারকার--শ্যামাপ্রসাদের মত হিন্দু মৌলবাদীদের ও মহম্মদ আলি জিন্না--ইকবাল প্রমুখ মুসলিম মৌলবাদীদের বিষাক্ত ভাবনা ও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের চক্রান্তের ককটেলে বিভক্ত হোল, তখন হিন্দু মৌলবাদীরা দাবী তোলেন যে ভারতকে বিভক্ত করে মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্থান হয়েছে, অতএব অবশিষ্ট ভারত হবে হিন্দুস্থান। কিন্তু মহাত্মা গান্ধীসহ খণ্ডিত ভারতের শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষরা ও জাতীয় কংগ্রেস এবং ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিসহ সকল বামপন্থী ও গণতান্ত্রিক দলগুলি ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ ঐতিহ্যকে বজায় রাখার উপর জোর দেন। ফলে এই ঐতিহ্যের আদর্শকে প্রতিধ্বনিত করে আমাদের সংবিধানের উল্লিখিত ধারাগুলির মধ্যে জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সকল মানুষের ধর্মচরণের অধিকার স্বীকৃত হয়েছে। ২৫ নং ধারায় বলা হয়েছে-- " . . . all persons are equally entitled to freedom of conscience and the right freely to profess, practise, and propagate religion." ২৬ নং ধারায় বলা হয়েছে-- " . . . every religious denomination or any section therof shall have the right.

(a) to establish and maintain institutions for religious and chartable purposes;

(b) to manage its own affairs in matters of religion. 

অর্থাৎ প্রত্যেক ধর্মীয় গোষ্ঠীর লোকরা ধর্মীয় ও দাতব্যগত কারণে তাদের নিজস্ব প্রতিষ্ঠান স্থাপন ও পরিচালন করতে পারবে। এই বিষয়ে সবার সমান অধিকার। এখানে কোন বৈষম্যের অবকাশ নেই।

মনে রাখা দরকার যে একটি ধর্মীয় রাষ্ট্র যেমন সাবেক হিন্দুরাষ্ট্র নেপালে, কিংবা বর্তমান ইসলামী রাষ্ট্র ইরাণ, ইরাক কিংবা আফগানিস্থানে, বা বৌদ্ধ ধর্মীয় রাষ্ট্র মায়ানমারে, অন্য ধর্মের লোকরা নির্ম্মমভাবে নির্যাতিত হয়। হিন্দু ধর্মের পবিত্রতা রক্ষার নামে কাঠমাণ্ডুতে নেপালী রাজতন্ত্রের আমলে সংখ্যালঘুদের উপর যে বর্বরতা হয়েছে, কিংবা আফগানিস্থানে শরিয়তী শাসনের নামে তালিবান আমলে সংখ্যালঘু হিন্দু--বৌদ্ধ--খৃশ্চানদের উপর যে পাশবিকতা হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে, সেখানকার বামিয়ানে হিন্দু ও বৌদ্ধ সংস্কৃতির নিদর্শনগুলিকে যেভাবে ধূলিস্যাৎ করা হয়েছে, তা সভ্যতার লজ্জা। একইভাবে ইরাণে শিয়া মৌলবাদ ও ইরাকে সুন্নী মৌলবাদ ইসলামের নামে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের উপর যে তাণ্ডব চালিয়ে যাচ্ছে তা অকল্পনীয়। অহিংসার বাণীর প্রচারক বুদ্ধদেবের নাম ভাঙিয়ে সুচির সরকারের মদতে মানায়মারে বৌদ্ধ মৌলবাদীরা কেবল মুসলিম হবার অপরাধে রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদেরকে নারী--শিশু--যুবা--বৃদ্ধ--বৃদ্ধা নির্বিশেষে, যেভাবে রক্তের বন্যায় ভাসিয়ে দিচ্ছে, সে নৃশংসতার বর্ণনা রক্ত--মাংস--হাড়কে হিম করে। বস্তুতঃপক্ষে, এইসব কারণেই প্যালেস্টাইন মুক্তি আন্দোলনের মহানায়ক, PLO প্রধান ইয়াসের আরাফৎ বলেছিলেন তাঁর মৃত্যুর কিছু আগে, "শরিয়তের নামেই হোক, আর বাইবেলের নামেই হোক, ধর্মীয় রাষ্ট্র মানেই হোল শয়তানদের দোজোক।" আরাফতের মূল্যায়ন সর্বাংশে সত্য। কোন ধর্মীয় রাষ্ট্রে ধর্ম বা ঈশ্বরের কোন ঠাঁই নেই। সেখানে আছে বা থাকে শুধু পাশবিকতা, নৃশংসতা, অকল্পনীয় বর্বরতা। ধর্মনিরপেক্ষ তথা বহুত্ববাদী সংস্কৃতির দেশেই কেবলমাত্র সকল মানুষ মৈত্রী ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে সকল মানুষ নিজ নিজ ধর্ম ও সংস্কৃতিকে রক্ষা করে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করতে পারে।

তাই ইতিহাস প্রমাণ করে যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানবতাবাদী রাষ্ট্র নায়করা দেশের সংবিধানের মধ্যে ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধোত্তর পরিস্থিতিতে ইন্দোনেশিয়ার রাষ্ট্রপতি সুকর্ণো, ঘানার নত্রুমা, শ্রীলঙ্কার বন্দরনায়েক, কঙ্গোর লুমুম্বা, চিলির রাষ্ট্রপতি সালভাদোর আলেন্দে, আফগানিস্থানে বারবাক কারমাল ও ডঃ নজিবুল্লাহ, মিশরের রাষ্ট্রপতি আব্দেল নাসের, সবাই সংবিধানের মধ্যে ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শকে স্থান দিয়েছিলেন। উল্লেখ্য যে "Muslim Brotherhood" বলে একটি উগ্র মুসলিম মৌলবাদী সংগঠন, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী নাসেরের জাতশত্রু মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের মদতে গুলি করে আলেকজান্দ্রিয়ায় এক সভায় নাসেরকে হত্যা করার অপচেষ্টা করে। গুলিটি লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ায় অল্পের জন্য নাসের বেঁচে যান। অতি সাম্প্রতিক কালে দক্ষিণ আফ্রিকার সংবিধানে রাষ্ট্র নায়ক নেলসন ম্যাণ্ডেলা ধর্ম নিরপেক্ষতার আদর্শকে স্বীকৃতি দেন।

আমাদের দেশ ভারতবর্ষের সংবিধানের মধ্যেও উল্লিখিত ধারাগুলির মাধ্যমে ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ স্বীকৃত হয়েছে। শুধু তাই নয়। ধর্মগত, ভাষাগত, জনগোষ্ঠীগত সংখ্যালঘুরা যাতে সংখ্যাগুরুদের চাপে, আত্মবিকাশে বিঘ্নিত না হয়, তার জন্য বিশেষ সুরক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমাদের দেশের সংবিধানের ৩০ নং ধারায় বলা হয়েছে-- "All minorities, whether based on religion or language, shall have the right to establish and administer educational institutions of their choice." অর্থাৎ ধর্ম ভিত্তিক বা ভাষা ভিত্তিক সংখ্যালঘুরা তাদের অভিরুচি অনুযায়ী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন ও পরিচালনা করতে পারবে।

উগ্র হিন্দু মৌলবাদীরা এই ৩০নং ধারাটির বিকৃত ব্যাখ্যা দিয়ে বলছে যে এই ধারার অস্তিত্ব হিন্দুদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার সামিল। তারা এই ধারার অপলোপ চায়। তাদের যুক্তি যে এই ধারা বলে মুসলিম, খৃশ্চান, বৌদ্ধ, জৈন প্রমুখ সংখ্যালঘুরা তাদের পছন্দমত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন ও পরিচালনা করে তাদের ধর্মীয় শিক্ষা সেখানে দিতে পারে। কিন্তু হিন্দুদের সেই সুযোগ নেই। এই বৈষম্য কেন থাকবে? এর অবলুপ্তি দরকার। এই বিকৃত প্রচারের দ্বারা তারা সাধারণ হিন্দু--ভাই বোনদেরকে বিভ্রান্ত করছে। সংবিধানের মধ্যে পূর্বোক্ত ২৫ ও ২৬ নং ধারার তো যথাক্রমে প্রত্যেকের স্বাধীনভাবে ধর্মাচরণের অধিকার ও প্রত্যেক ধর্মীয় সম্প্রদায়ের পছন্দমত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও দাতব্য প্রতিষ্ঠান খোলার অধিকার দেওয়া আছে। কাজেই অকারণে ৩০ নং ধারা নিয়ে অপপ্রচার করে সংখ্যাগুরু হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ জনের সাথে, সংখ্যালঘু মুসলিম, খৃশ্চান প্রমুখ সম্প্রদায়ের মানুষদের এক মানসিক দূরত্ব তৈরী করা হচ্ছে। এর পরিণাম হবে ভয়ংকর। গোটা দেশটা তাসের ঘরের মত ভেঙ্গে পড়বে। এটা আমরা, এদেশের শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষরা কিছুতেই হতে দিতে পারি না। এই অপচেষ্টাকে আমরা রুখবোই রুখবো--এ আমাদের দৃঢ় অঙ্গীকার।

আসলে ইংরাজীতে "Preotective Discrimination" বা সুরক্ষা মূলক বৈষম্য বলে একটি কথা আছে। সমাজের দুর্বল অংশের মানুষদের জন্য এই পদক্ষেপ নিতে হয়। বিশ্বের বহুদেশে এর নজির আছে। ১৯৩৬ সালের সোভিয়েত সংবিধানে অর্থাৎ স্টালিন সংবিধানে কিংবা ১৯৭৭ সালের ব্রেজনেড সংবিধানে এটা ছিল, সুইজারল্যাণ্ডে বিভিন্ন ক্যান্টনে এই ব্যবস্থা আছে, নাসেরের আমলে মিশরের রাষ্ট্রবাবস্থায় খৃশ্চান, ইহুদি ও অন্যান্য সংখ্যা লঘুদের জন্য এই সুরক্ষামূলক বৈষম্যের ব্যবস্থা ছিল। যে শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদী শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করে লেনসন ম্যাণ্ডেলা দক্ষিণ আফ্রিকায় শ্বেতাঙ্গ বর্ণ বৈষম্যবাদী শাসনের অবসান ঘটিয়েছিলেন, সেই দক্ষিণ আফ্রিকায় যাতে সংখ্যালঘু শ্বেতাঙ্গরা সংখ্যাগুরু কৃষ্ণাঙ্গদের শাসনে কোন বৈষম্যের শিকার না হন, তার জন্য সংখ্যালঘু শ্বেততাকারদের সুরক্ষার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা ম্যাণ্ডেলা প্রশাসন গ্রহণ করেন। দাসত্ব প্রথা অবলোপের পর মার্কিন রাষ্ট্রপতি আব্রাহাম লিঙ্কন উদ্যোগ নিয়েছিলেন বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে বর্ণগত সংখ্যালঘুদের স্বার্থে সুরক্ষামূলক বৈষম্যবাদী পদক্ষেপ চালু করতে। কিন্তু, তার আগে তিনি খুন হন দাসপ্রভুদের চক্রান্তে। 

বিগত শতাব্দীর ত্রিশের দশকে বিশ্বব্যাপী মন্দার প্রেক্ষাপটে মার্কিন রাষ্ট্রপতি রুজভেল্ট "New Deal" কর্মসূচীর মাধ্যমে সমাজের দূর্বল অংশের মানুষকে কিছু বিশেষ সুরক্ষা দিতে চেয়েছিলেন। এর জন্য তাঁকে মার্কিন সুপ্রীমকোর্টের সঙ্গে অনেক লড়তে হয়েছিল। আমাদের দেশে ১৯৩২ সালে, আইন অমান্য আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে লণ্ডনে গোল টেবিল বৈঠকে মহাত্মা গান্ধী ভারতের জন্য পূর্ণ স্বাধীনতার দাবী তুলতে গিয়ে জিন্না ও আম্বেদকরের কাছে সমর্থন চেয়ে এ ব্যাপারে আবেদন করেন। কিন্তু জিন্না শর্ত দেন যে গান্ধীজী মুসলিমদের জন্য বিশেষ সুযোগ সুবিধার দাবী মানলে তবে তিনি এই প্রস্তাবকে সমর্থন করবেন; আম্বেদকর একই সুরে শর্ত দেন অনুন্নত জাতিগুলির জন্য বিশেষ সুবিধার দাবী গান্ধীজী মানলে তবে তাঁকে সমর্থন। জাতীয় কংগ্রেসের মধ্যে মৌলানা আবুল কালাম আজাদ থেকে শুরু করে ডঃ রাধাকৃষ্ণান কেউই এক দাবীকে মানার পক্ষে ছিলেন না। তাঁদের সবার মত ছিল জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সবার কল্যাণ। গান্ধীজীরও অভিমত ছিল তাই। তিনি বলেন "সর্বোদয়" অর্থাৎ সবার মঙ্গল সাধনই তাঁর লক্ষ্য -- কোন বিশেষ সম্প্রদায়ের নয়। ফলে গোলটেবিল বৈঠক ভেস্তে গেল।

গণপরিষদে যখন আমাদের সংবিধান রচিত হচ্ছিল, তখন এই "Preotective Discrimination"-এর প্রসঙ্গটি ওঠে। গণপরিষদের একমাত্র কমিউনিস্ট সভ্য কমরেড সোমনাথ লাহিড়ী খুব জোরের সঙ্গে ৩০ নং ধারার সংযোজনকে সংবিধানে অন্তর্ভুক্তির উপর জোর দেন সমস্ত ধর্মগত ও ভাষাগত সংখ্যালঘুদের স্বার্থে। সেই সঙ্গে শিক্ষা--চাকুরি ইত্যাদি ক্ষেত্রে সংরক্ষণের প্রশ্নে আম্বেদকর নির্দেশিত জাতপাত ভিত্তিক ব্যবস্থা (Caste based reservation) র পরিবর্তে অর্থনৈতিক ভিত্তিক সংরক্ষণের কথা বলেন। তাঁর এই দ্বিতীয় প্রস্তাব গৃহীত হয়নি। দেশের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষরা জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে অর্থনৈতিক ভিত্তিক সংরক্ষণের জন্য লড়ছেন। সে লড়াই যে অচিরেই জয়যুক্ত হবে, এ আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস। আর উল্লিখিত ৩০ নং ধারাকে সংবিধান থেকে খারিজ করে দিয়ে আমাদের দেশের ধর্ম-নিরপেক্ষতার ঐতিহ্যকে বিপন্ন করার যে ধূর্ত গৈরিকী অপপ্রয়াস, তাকে ব্যর্থ করে দিয়ে অশোক--আকবর--দারাশিকো--বিবেকানন্দ--রবীন্দ্রনাথের-নজরুলের উত্তরসূরীরা যে আমাদের দেশের বহুত্ববাদী পরম্পরাকে রক্ষা করবেনই করবেন, সে বিষয়ে আমরা নিযুত নিশ্চয়। 

 

      

 

লেখক পরিচিতি

অধ্যাপক খগেন্দ্রনাথ অধিকারী রাষ্ট্রীয় বিদ্যাসরস্বতী পুরস্কার ও এশিয়া প্যাসিফিক পুরস্কার সহ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বহু পুরস্কার প্রাপ্ত একজন খ্যাতনামা শিক্ষাবিদ। ইনি কোলকাতার সাউথ সিটি (দিবা) কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ।

ঠিকানা-শরনিয়ার বাগান

পোষ্ট-টাকী, পিন-৭৪৩৪২৯

পশ্চিমবঙ্গ, ভারত

 

১১:১০ এএম, ২৫ জুন ২০২৪ মঙ্গলবার

শাসকের সঙ্গে সংঘাত ও বিচারালয়ের বাড়াবাড়ি

শাসকের সঙ্গে সংঘাত ও বিচারালয়ের বাড়াবাড়ি

শাসকের সঙ্গে সংঘাত ও বিচারালয়ের বাড়াবাড়ি
মজিবুর রহমান

     পশ্চিমবঙ্গে শাসকের সঙ্গে আদালতের সংঘাত লেগেছে। অন্তত তিন বছর ধরে এই লড়াই জোরকদমে চলছে। প্রশাসনিক হেডকোয়ার্টার নবান্ন আর কলকাতা হাইকোর্টের কাজিয়া সুপ্রিম কোর্টে গিয়ে জমা পড়ছে। দুশ্চিন্তা ও দুর্ভাবনার শিকার হচ্ছে রাজ্যের লাখ লাখ সাধারণ মানুষ। সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি হচ্ছে।সাংঘাতিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিক্ষার মতো খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি ক্ষেত্র। এই পরিস্থিতির জন্য সরকার ও আদালত উভয়েরই দায় রয়েছে। কেউই সমস্যার সমাধানে আন্তরিক নয়। বরং সমস্যাকে জটিল থেকে জটিলতর ও দীর্ঘমেয়াদি করা হয়। এখানে তিনটি বিচারবিভাগীয় নির্দেশ ও সেগুলোর অভিঘাত নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করা হল।
      বিগত কয়েক বছরে রাজ্যের সরকারি বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী নিয়োগ প্রক্রিয়ায় নানান ধরনের নিয়ম ভঙ্গের ঘটনা ঘটেছে। অজ্ঞতাবশত বা অনিচ্ছাকৃত ভুল নয় , বেশ পরিকল্পনা করে নিয়োগ প্রক্রিয়ার বিভিন্ন স্তরে বিভ্রাট ঘটানো হয়েছে। স্বজন পোষণ ও বিশাল অঙ্কের আর্থিক লেনদেন হয়েছে।পুরো ঘটনাটা একটা প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন সাংসদ, বিধায়ক, মন্ত্রী, সরকারি আধিকারিক ও শাসক দলের নেতাকর্মীরা। গত দুই বছরে ২৫-৩০ জনকে ধরা হয়েছে। ২০১৬ সালের স্কুল সার্ভিস কমিশনের প্যানেলে উত্তরপত্র তথা অপটিক্যাল মার্ক রেকগনিশন (ও এম আর) শীট বিকৃতি, সিরিয়াল ব্রেক, প্যানেলের বাইরে থেকে নিয়োগ, সুপার নিউমেরিক পোস্ট সৃষ্টি সহ বেশ কয়েক রকমের অনিয়মের সন্ধান পাওয়া গেছে। ওই প্যানেল থেকে ২৬ হাজার শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী নিযুক্ত হন। তদন্তের স্বার্থে সকলের নথিপত্রের হার্ডকপি জেলায় জেলায় ডিআই অফিসে অথবা কলকাতায় মধ্যশিক্ষা পর্ষদের অফিসে জমা করা হয়। ফোনের মাধ্যমেও তথ্য প্রদান করা হয়। সবকিছু যাচাই করে দেখা যায়, নিয়ম ভঙ্গ করে নিয়োগপত্র পাওয়া শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীর সংখ্যা আট হাজারের কম আর নিয়ম মেনে নিযুক্ত হয়েছেন আঠারো হাজারের বেশি। অর্থাৎ বৈধ শিক্ষকের সংখ্যা অবৈধ শিক্ষকের থেকে অনেকটাই বেশি। কাঁকড় বেছে ফেলার পর খাদ্য শস্য ভক্ষণ করাই সাধারণ নিয়ম। জমি থেকে আগাছা পরিষ্কার করে আমরা সবাই ফসল রক্ষা করি। আগাছার সাথে ফসল কেটে ফেলি না। কিন্তু কলকাতা উচ্চ আদালতের ডিভিশন বেঞ্চ নিয়োগ মামলার রায় দিতে গিয়ে আগাছার সাথে ফসলও কেটে ফেলার নিদান দিয়েছে।কাঁকড় না বেছে সমস্ত শস্য কণা ডাস্টবিনে ফেলার ফতোয়া জারি করেছে। ২০১৬ সালের শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীদের সব প্যানেল বাতিল। 'ঢাকি সমেত বিসর্জন'।সকলের চাকরি ক্যানসেলড। এটা কোনো বিচার হল? ন্যায়বিচারের কোনো উপাদান কি এই রায়ের মধ্যে রয়েছে? বৈধ ও অবৈধ ভাবে নিযুক্ত উভয়েরই এক পরিণতি! মুড়ি-মিছরির এক দর! ডিভিশন বেঞ্চ সাফাই দিয়েছ, বারবার বলা সত্ত্বেও নাকি নিয়োগ প্রক্রিয়ার দুই প্রধান সংস্থা স্কুল সার্ভিস কমিশন ও মধ্যশিক্ষা পর্ষদ আদালতের কাছে বৈধ ও অবৈধ কর্মপ্রার্থীদের তালিকা জমা দেয়নি।তাই আসল ও নকলকে আলাদা করা যায়নি।কিন্তু প্রশ্ন হল, কমিশন ও পর্ষদ ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করেনি বলে বৈধ চাকরিজীবীরা বরখাস্ত হয়ে যাবেন? যারা আদালতের সঙ্গে সহযোগিতা করেনি আদালত তাদের শাস্তি দিক। তাদের বাধ্য করুক প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ করতে। কমিশন ও পর্ষদের দু'চারজন আধিকারিককে বাগে আনতে না পেরে হাজার হাজার চাকরিজীবীকে ব্যতিব্যস্ত করার কোনো মানে হয়? আজকের দিনে একটা সরকারি চাকরি পাওয়া 'ভগবানের সাক্ষাৎ' পাওয়ার সমান! অথচ বৈধভাবে অর্জন করা চাকরিকে কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। ২০১৬ সালের প্যানেলে এমন অনেকেই আছেন যাঁরা ২০১১ সালের প্যানেলের চাকরি ছেড়ে এসেছেন। মাদ্রাসা সার্ভিস কমিশনের প্যানেল থেকে পাওয়া চাকরি ছেড়ে এসেছেন।অন্য কোনো পেশার চাকরি ছেড়ে এসেছেন। অর্থাৎ এঁরা একাধিকবার সফলভাবে যোগ্যতার প্রমাণ দিয়ে চাকরি করছিলেন।আদালত কোনো বাছবিচার না করে সকলকেই বাতিল করে দিল। ভেবে দেখা হল না, একটি চাকরি একটি নিম্নবিত্ত অথবা মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য কত গুরুত্বপূর্ণ! চাকরি করার সুবাদে ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নিয়ে বহুজন গাড়ি বাড়ি করেছেন। বেতন থেকে ঋণের কিস্তি মেটানো হয়। হঠাৎ বেতন বন্ধ হলে তাঁরা কিভাবে ঋণ পরিশোধ করবেন? সুদ সহ বেতন ফেরতের নির্দেশ আরও মারাত্মক।ক'জন এই নির্দেশ পালন করতে পারবেন, সন্দেহ আছে। অনেকেই ভিটেমাটি ছেড়ে পালাবেন। আত্মহননের পথ বেছে নিতে বাধ্য হবেন। একসঙ্গে এতজন শিক্ষক চাকরিচ্যুত হলে স্কুলগুলোর অবস্থা কী হবে কেউ কি ভেবে দেখেছে? এখন রাজ্যের অধিকাংশ স্কুলে শিক্ষার্থীর তুলনায় শিক্ষকের সংখ্যা অনেক কম। স্কুল ফান্ড থেকে যৎসামান্য পারিশ্রমিকের বিনিময়ে চুক্তিভিত্তিক অস্থায়ী শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী নিয়োগ করে জোড়াতালি দিয়ে চলছে। এই মুহূর্তে অনেক স্কুলে ২০১৬ সালের প্যানেলের শিক্ষকই বেশি। একসঙ্গে অর্ধেক শিক্ষক বিদায় নিলে স্কুলগুলো চলবে কী করে! নতুন নিয়োগের ব্যাপারে কোর্টের কোনো কড়া নির্দেশনা নেই, শুধু বাতিলের বেলায় বড় বড় বক্তব্য! সরকারি স্কুল ছেড়ে মেধাবী ও আর্থিক সঙ্গতি সম্পন্ন পরিবারের ছেলেমেয়েরা সব প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে চলে যাচ্ছে। শিক্ষার বেসরকারিকরণ ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যেই কি কোনো বৃহত্তর ষড়যন্ত্র চলছে?
       মুর্শিদাবাদ জেলার একটি হাইস্কুলের একজন প্রধানশিক্ষক স্কুল সার্ভিস কমিশনের সুপারিশ পত্র ও মধ্যশিক্ষা পর্ষদের নিয়োগপত্র জাল করে তাঁর ছেলেকে নিজের স্কুলেই চাকরিতে ঢোকান। কোর্টের নির্দেশে সিআইডি তদন্ত করে। অভিযুক্ত পিতা-পুত্র ও দুজন শিক্ষা আধিকারিক কারাবাস ভোগ করেন। এসব ২০২২-২৩ সালের ঘটনা।এই নিয়োগ কেলেঙ্কারির প্রেক্ষাপটে এবছর মে মাসের দ্বিতীয়ার্ধে রাজ্যের সমস্ত হাইস্কুলের সকল শিক্ষক-শিক্ষিকার নিয়োগ সংক্রান্ত তথ্য পোর্টালে আপলোড করার নির্দেশ দেওয়া হয়। হার্ডকপি ডিআই অফিসে জমা করতে বলা হয়। নথিপত্রে শিক্ষকদের সেল্ফ অ্যাটেসটেড করতে বলা হয়।এই কাজ করার জন্য স্কুলগুলো এক সপ্তাহের মতো সময় পায়। তখন রাজ্যে গরমের ছুটি ও লোকসভা নির্বাচন চলছিল।গ্ৰীষ্মাবকাশে অনেকেই চিকিৎসা করাতে অথবা ঘুরতে ভিন রাজ্যে বা বিদেশে যান।একটা পুরনো ঘটনায় দীর্ঘাবকাশের মধ্যে এমন জরুরি ভিত্তিতে নথিপত্র চাওয়ার কোনো যুক্তি থাকতে পারে না। এই ধরনের আকস্মিক নির্দেশে অফিস আদালতের স্বেচ্ছাচারী মানসিকতাই প্রকাশ পায়।পশ্চিমবঙ্গে এখন দশ হাজার হাইস্কুলে দেড় লাখ শিক্ষক আছেন। মাত্র একজন শিক্ষকের নিয়োগের ক্ষেত্রে গুরুতর জালিয়াতির অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে।কারা এর সঙ্গে জড়িত তাও জানা গেছে।আইন অনুযায়ী তাদের যত কড়া শাস্তি দেওয়া যায় দেওয়া হোক। কিন্তু একটা স্কুলের একজন শিক্ষকের অপরাধের জন্য রাজ্যের হাজার হাজার স্কুলের লক্ষাধিক শিক্ষককে তদন্তের আওতায় টেনে আনার কোনো মানে হয়? একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনার জন্য এখন সবাইকেই সন্দেহ করতে হবে? বিড়ম্বনায় ফেলতে হবে? বিশ-ত্রিশ বছর চাকরি করার পর আবার নথিপত্র দেখাতে হবে? মশা মারতে কামান দাগা হচ্ছে!
       গত ২২শে মে কলকাতা হাইকোর্টের একটি ডিভিশন বেঞ্চ ২০১০ সালের পর থেকে রাজ্য সরকারের প্রদান করা সমস্ত ওবিসি সার্টিফিকেট বাতিল বলে রায় দিয়েছে। ২০১১ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বর্তমান রাজ্য সরকারের আমলে প্রায় পাঁচ লক্ষ ওবিসি সার্টিফিকেট ইস্যু করা হয়েছে। হাইকোর্ট এগুলোকে বাতিল ঘোষণা করেছে। ইতিমধ্যে এই সার্টিফিকেট ব্যবহার করে যে সুবিধা ভোগ করা হয়েছে তার ওপর কোনো নেতিবাচক প্রভাব না পড়লেও পরবর্তীতে অনুরূপ ছাড় আর পাওয়া যাবে না। রায়ে বলা হয়েছে, ১৯৯৩ সালের অনগ্ৰসর শ্রেণী কমিশন আইন অনুযায়ী ওবিসি'র তালিকা তৈরি করতে হবে। ঘটনা হল, ১৯৯৩ সালের আইন অনুযায়ী ২০০৯ সালে কিছু জনগোষ্ঠীকে ওবিসি হিসেবে চিহ্নিত করা হয় এবং তাদের জন্য শিক্ষা ও চাকরিতে সংরক্ষণ চালু করা হয়।এই জনগোষ্ঠীর অধিকাংশই ছিল মুসলমান। ২০১২ সালে আরেকটি আইন তৈরি করে অন্যান্য অনগ্ৰসর শ্রেণীর তালিকায় আরও কিছু জনগোষ্ঠীকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।এদেরও অধিকাংশই মুসলমান। ওবিসি'র তালিকায় ধাপে ধাপে জনগোষ্ঠী সংযোজন একটি স্বাভাবিক ঘটনা।ওবিসি'র তালিকায় জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও ওবিসি'র জন্য সংরক্ষণ কিন্তু বাড়েনি। সংরক্ষণের হার বাড়েনি বলে ওবিসি'র সুবিধাভোগীদের মধ্যে শুধুমাত্র প্রতিযোগিতা তীব্রতর হয়েছে।বিষয়টি এভাবে দেখা যেতে পারে: একটি ওবিসি সংরক্ষিত পদের জন্য ২০১২ সালের আগে হয়ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগ পেত পাঁচটি জনগোষ্ঠী, এখন পায় সাতটি। এছাড়া এর আর কোনো তাৎপর্য নেই। আদালত ২০১০ সালের পরের সমস্ত ওবিসি শংসাপত্র বাতিল করলেও ২০১২ সালের যে আইনের ভিত্তিতে শংসাপত্রগুলো প্রদান করা হয়েছিল সেই আইনকে কিন্তু বাতিল করা হয়নি। ২০১২ সালের আইন যদি অসাংবিধানিক না হয় তবে সেই আইন অনুযায়ী ইস্যু করা সার্টিফিকেট কেন বাতিল হবে? ২০১২ সালের আইন যদি বেআইনি না হয় তবে ১৯৯৩ সালের আইনকে কেন ভিত্তিভূমি ধরতে হবে? একই বিষয়ে যদি একাধিক আইন থাকে তবে তো সর্বশেষ আইনকেই অগ্ৰাধিকার দেওয়ার কথা।এক খোঁচাতেই পাঁচ লাখ মানুষের সার্টিফিকেট ক্যানসেল করে দেওয়া হল। কিন্তু ভেবে দেখা হল কি ওই সার্টিফিকেট পেতে কী পরিমাণ কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে? কত সাপোর্টিং ডকুমেন্ট সংগ্ৰহ করতে হয়েছে? হঠাৎ করে এত সংখ্যক সার্টিফিকেট বাতিল হওয়ার ফলে অনেক সমস্যা দেখা দিতে পারে। চাকরিতে যে 'হান্ড্রেড পয়েন্ট রোস্টার' অনুসরণ করা হয় তাতে ওবিসি'র জন্য সতের শতাংশ সংরক্ষণ থাকে।বিগত বারো-চোদ্দো বছরের সমস্ত সার্টিফিকেট বাতিল হবার ফলে সংরক্ষিত আসনে প্রয়োজনীয় সংখ্যক কর্মপ্রার্থী পাওয়া কঠিন হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ওবিসি শিক্ষার্থীদের জন্য সংরক্ষিত আসন কোনভাবেই পূরণ হবে না। ওবিসি'দের জন্য যে ছাত্র বৃত্তি রয়েছে তাতে কেউ আবেদনকারী হতে পারবে না। তফসিলি জাতি ও তফসিলি জনজাতির সঙ্গে অন্যান্য অনগ্ৰসর শ্রেণীর আর্থ-সামাজিক পশ্চাৎপদতার দিক থেকে বিশেষ পার্থক্য নেই। ফারাক যেটুকু আছে তা ধর্মীয় পরিচয়ে। এস সি-এস টি'রা অধিকাংশই হিন্দু আর ওবিসি'রা অধিকাংশই মুসলমান।দুর্ভাগ্যবশত, স্বাধীনতার সাড়ে সাত দশক পরে ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের অঙ্গরাজ্য পশ্চিমবঙ্গে মানুষের ধর্মীয় পরিচয়কে প্রাধান্য দিয়ে ওবিসি সার্টিফিকেট বাতিল করছে বিচারালয়। বিচারের বাণী কি বৈষম্যমূলক হয়ে যাচ্ছে না? আদালত সাধারণ মানুষের ভরসার জায়গা।সেই জায়গা থেকেই বারবার ধাক্কা খেয়ে মানুষ আজ বিভ্রান্ত, বিপন্ন।

০৭:৫১ এএম, ২১ জুন ২০২৪ শুক্রবার

Meditation

Meditation" নয়, "Media-Attention": মানুষের চোখ খুলেছে

"Meditation" নয়, "Media-Attention": মানুষের চোখ খুলেছে
খগেন্দ্রনাথ অধিকারী

ধ্যান আর ধ্যানাচি এক নয়: একইভাবে "Meditation" আর "Media-Attention" ও এক নয়। হিটলার আর্যরক্তের পবিত্রতার দোহাই পেড়ে অগণিত ইহুদির রক্তে হাত রাঙিয়ে, নিজের পক্ষে অ-ইহুদিদের ভাবাবেগকে কাজে লাগাতে, চরম ব্যভিচারী জীবন যাত্রা তার রক্ষিতা ইভা ব্রাউনের সঙ্গে অব্যাহত রেখে হঠাৎ খুব ঈশ্বরভক্তি তথা ধর্মকর্ম করার ভান করেন। কিন্তু তাতে তাঁর, তাঁর রক্ষিতা ইভার, কিংবা গোটা নাৎসীদের রেহাই হয়নি। সোভিয়েত লাল ফৌজের হাতে তাদের বিনাশ ঘটেছে, ভূগর্ভস্থ বাঙ্কারে হিটলার--ইভাকে যথাক্রমে পিস্তলের গুলি ও সায়নায়েড ক্যাপসুলে আত্মহত্যা করতে হয়েছে। উগ্র মুসলিম বিদ্বেষে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু ও তাঁর মদতদাতা মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন হাজার হাজার নিরপরাধ প্যালেস্টাইনবাসীকে খুন করে ইহুদি ভাবাবেগকে কাজে লাগাতে এখন "জিহোভা"র দোহাই পাড়ছে। কিন্তু তাতে কোন লাভ হচ্ছে না। খোদ ইসরায়েলে রাজধানী শহর জেরুশালেমে ও প্রধান বাণিজ্য শহর তেল আভিভে জেরুজালেমে ও প্রধান বাণিজ্য শহর তেল আভিভে ইহুদিরা প্যালেস্টাইনকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে মেনে নেবার দাবী তুলে রাজপথে নেমেছে। একইভাবে মার্কিন জণগন জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সে দেশের বড় বড় শহরগুলিতে উত্তাল বিক্ষোভে সরব হয়ে উঠেছেন। অর্থাৎ, মানুষের খুনে হাত রাঙিয়ে এখন ঈশ্বর ভক্তির ভেক ধরে শতচেষ্টা করেও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও তার তাঁবেদার ইসরায়েল এখন হালে পানি পাচ্ছে না।
মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের আর তার উচ্ছিষ্টভোগী তথা ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর দোসর, আমাদের দেশের বি. জে. পি সরকারের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী উগ্র হিন্দুত্ববাদী তথা মুসলিম ও খৃশ্চান বিদ্বেষবাদী দৃষ্টি কোণে অশোক--আকবর--দারাশিকো--বিবেকানন্দ--রবীন্দ্রনাথ--নজরুলের মাটিকে, গঙ্গা--যমুনা--গোদাবরী--সবরমতির তরঙ্গ বিধৌত ভূমিকে রক্ত সিক্ত করেছেন, দেশের ঐক্য, সংহতি ও ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানকে বিপন্ন করেছেন ও করছেন, সর্ব্বোপরি এই লোকসভা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিভাজনের রাজনীতির বিষবাষ্প ছড়িয়ে গোটা দেশে বিষাক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করেছেন।
১লা জুন হয়েছে শেষ দফার ভোট। ৩০শে মে বিকেলে হয়েছে শেষ দফার ভোটের প্রচার শেষ। তার আগেই এই ৩০ তারিখে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী গেরুয়া বসন পরে বসেছেন কন্যাকুমারিকায় বিবেকানন্দ রকে তথাকথিত ধ্যানে অর্থাৎ Meditation-এ। আসলে এটাও ১লা জুন ভোট শেষ হবার আগের মুহুর্ত পর্যন্ত হিন্দু ভাবাবেগকে উস্কে ভোট দাতাদেরকে Media-Attention মারফৎ অর্থাৎ গণপ্রচার মাধ্যম মারফৎ প্রভাবিত করার এক সুচতুর কৌশল। শুধু তাই নয়। লক্ষণীয় যে ১লা জুন শেষ দফায় পশ্চিমবঙ্গের প্রায় এক চতুর্থাংশ অর্থাৎ নয়টি আসনে ভোট হবে। এই রাজ্যেরই মানুষ ছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ। সুতরাং একইসঙ্গে হিন্দুভাবাবেগ ও বাঙালী ভাবাবেগকে উস্কে এই আসনগুলির ভোট দাতাদেরকে পদ্ম শিবিরের দিকে প্রভাবিত করার লক্ষ্যে কন্যাকুমারিকার বিবেকানন্দ রককে ধ্যানের জায়গা হিসাবে বাছাই করা হয়েছে।
কিন্তু, পশ্চিমবাংলার মানুষ তথা সারা ভারতবর্ষের মানুষ অতো মূর্খ নন। তথাকথিত ধ্যানের নামে ধ্যানাচির চালাকি খুব ভালো তাঁরা বোঝেন। তাই বিগত লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল থেকে বোঝা যায় যে ভারতের সিংহভাগ মানুষ হিন্দু ধর্মাবলম্বী হলেও, বি. জে. পি চল্লিশ শতাংশের চেয়েও অনেক অনেক কম ভোট পেয়েও সরকারে গেছে আমাদের দেশের বহুদলীয় সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার কারণে। কি বাঙালী, কি অবাঙালী নির্বিশেষে এই দেশের শুভবুদ্ধি সম্পন্ন হিন্দুরা আর যাই হোক মানবী মাতার সন্তান: তাঁরা জয় সিয়ারামের চেলাচেলীদের মত "গো মাতার" সন্তান নন। তাই তাঁরা স্বামী বিবেকানন্দের জীবনের ইতিহাসটা জানেন। তাঁরা জানেন যে স্বামীজী ভারতমাতার সন্ধানে বেরিয়ে কাশ্মীরে ঝিলাম নদীর এক মুসলিম মাঝির কিশোরী কন্যাকে মাতৃজ্ঞানে পূজো করেছিলেন এবং সেখান থেকেই শারদীয়া মহাষ্টমী তিথিতে হয়েছিল কুমারী পূজার চল। সুতরাং স্বামী বিবেকানন্দের মূর্তির সামনে বিবেকানন্দ রকে বসে গেরুয়া বসন পরে ধ্যানের ধ্যানাচী করে না বাঙালী হিন্দু, না অবাঙালী হিন্দু, কোন ধর্মনিরপেক্ষ হিন্দুকে প্রভাবিত করা যাবে না। এই ধরনের শুভবুদ্ধি সম্পন্ন হিন্দুদের সংখ্যাই এদেশে বেশী এবং তাঁরা মুসলিম--খৃশ্চান--বৌদ্ধ--জৈন সবার সঙ্গে মৈত্রীর আবেশে বসবাস করতে চান এবং বসবাস করে আসছেন। শুধুমাত্র অ বি. জে. পি ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলির মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়ার অভাবেই বিগত নির্বাচনগুলিতে কেন্দ্র ও বিভিন্ন রাজ্যে বি. জে. পি ক্ষমতায় এসেছে ৩৫%-৪০% এর মধ্যে ভোট পেয়ে: কোথাও কোথাও তার চেয়েও কম ভোট পেয়ে।
এবারের পরিস্থিতি অনেকটাই অন্য রকমের। বাম ও গণতান্ত্রিক দলগুলি নূন্যতম কর্মসূচীর ভিত্তিতে ইন্ডিয়া জোট তৈরী করেছেন ফলে অ-বি. জে. পি ভোটের বিভাজন কম হবে। তাই নরেন্দ্র মোদীদের ক্ষমতাচ্যূত হবার সম্ভাবনা প্রবল। সে কারণ Meditation -এর নামে "Media-Attention" "Draw" করে শেষ পর্বের ভোট দাতাদেরকেও প্রভাবিত করার জন্য এই ছলনার আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। মনে রাখতে হবে যে বিশ্বের যে কোন ধনবাদী দেশগুলির মত আমাদের দেশেও "Media" অর্থাৎ গণমাধ্যমগুলি, যথা বেতার, দূরদর্শন, সংবাদপত্র ইত্যাদি সবগুলিই বড় বড় ধনীক গোষ্ঠীর হাতে। মোদী সরকার তো তাদেরই সেবা দাস। তারা তাদের স্বার্থেই চায় বি. জে. পি ক্ষমতায় ফিরে আসুক। তাই ধর্মীয় ভাবাবেগ সৃষ্টিকারী ফটো, অর্থাৎ নরেন্দ্র মোদীর গেরুয়া বসন পরা ধ্যান মগ্ন ছবি প্রচার করে হিন্দু ভোট দাতাদের মন জয় করার কাজে গণমাধ্যমগুলি কোমর বেঁধে লেগেছে।
কিন্তু এরা মূর্খ। এরা ইতিহাসের শিক্ষাটা জানে না। নরেন্দ্র মোদীদের ভাবগুরু হিটলারের প্রচার সচিব গোয়েবেলস্‌ ছিলেন ভাণ্ডামি ও মিথ্যাচারের "সিদ্ধ (কু) পুরুষ"। তিনি বলতেন একটা মিথ্যা কথা একশবার বললে, কিংবা একটা ভণ্ডামি একশবার করলে, একশ একবারের বার মানুষ সেটাকে সত্য বলে মনে করবে। কিন্তু সেই কুখ্যাত গোয়েবলস্‌ ও বাঁচেননি, বাঁচাতে পারেননি তাঁর মহানায়ক হিটলারকে। একইভাবে আমাদের দেশের বৃহৎ ধনী পরিবারগুলির নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যমগুলিও পারবে না মোদী রাজকে অর্থাৎ বি. জে. পি শাসনকে বাঁচাতে ঐ ধ্যানের ধ্যানাচি করা ছবি দেখিয়ে।
মোট কথা, সামাজিক বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার গবেষণালব্ধ ফলের ভিত্তিতে একথা বলা যায় যে মানুষের আর্থ--সামাজিক--রাজনৈতিক আচরণের উপর "Media-Attention" বা গণমাধ্যমের প্রচারের একটা প্রভাব আছে। প্রভাব আছে বলেই তো গোয়েবলস্‌ এর মত শয়তান প্রচার সচিবের দৌলতে হিটলার এতখানি অক্সিজেন পেয়েছিলেন। না হলে বহু আগেই তাঁর পতন হোত। কিন্তু এটাও এর থেকে পরিষ্কার যে মিথ্যা প্রচার বা ভনিতা সাময়িকভাবে মানুষকে গণমাধ্যমের দ্বারা বিভ্রান্ত করতে পারে, কিন্তু বেশীদিন পারে না। সত্য প্রকাশ হয়ই হয় এবং তখন মানুষ ঐ অপপ্রচারকারীদের চরম দণ্ড দেয়, যেমন ঘটেছিল নাৎসী ও ফ্যাসিস্টদের কপালে। আমাদের দেশেও নরেন্দ্র মোদী ও তার চেলাদের কপালে ঐ একই জিনিষ ঘটবে--ভণ্ডামী ও ধাপ্পাবাজির মুখোষ খুলতে আর দেরী নেই, যেমন দেরী হয়নি জো-বাইডেন ও বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুদের মুখোশ খুলতে। সব ধাপ্পাবাজি ও ভণ্ডামি বুঝতে পেরে উত্তর গোলার্ধের আয়ারল্যাণ্ডসহ একাধিক দেশ প্যালেস্টাইনকে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং আরও অনেক দেশ সেই পথে এগুচ্ছে।
তাই বলি, আমাদের দেশের ধর্মনিরপেক্ষ শুভবুদ্ধি সম্পন্ন "Public" আমাদের এই গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ সার্ব্বভৌম "Republic" কে জয় সীয়ারামদের রাক্ষসকূলের হাত থেকে রক্ষা করবে, আবার দিকে দিকে ভেসে উঠবে, নজরুলের সেই হৃদয় জুড়ানো গান--
"মোরা একই বৃন্তে দু'টি কুসুম হিন্দু মুসলমান,
মুসলিম তার নয়ন মণি,
হিন্দু তাহার প্রাণ।"
(লেখকের নিজস্ব মতামত)

      
লেখক পরিচিতি
অধ্যাপক খগেন্দ্রনাথ অধিকারী রাষ্ট্রীয় বিদ্যাসরস্বতী পুরস্কার ও এশিয়া প্যাসিফিক পুরস্কার সহ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বহু পুরস্কার প্রাপ্ত একজন খ্যাতনামা শিক্ষাবিদ। ইনি কোলকাতার সাউথ সিটি (দিবা) কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ।
ঠিকানা-শরনিয়ার বাগান
পোষ্ট-টাকী, পিন-৭৪৩৪২৯
পশ্চিমবঙ্গ, ভারত

০৪:৫৯ পিএম, ২ জুন ২০২৪ রোববার

চেনা মুর্শিদাবাদে অচেনা ভোট 

চেনা মুর্শিদাবাদে অচেনা ভোট 

চেনা মুর্শিদাবাদে অচেনা ভোট 

     ১৮তম লোকসভা নির্বাচনে মুর্শিদাবাদ জেলার ভোট শেষ হয়েছে। ৭ই মে তৃতীয় দফায় ৯ নম্বর জঙ্গিপুর ও ১১ নম্বর মুর্শিদাবাদ কেন্দ্রে এবং চতুর্থ দফায় ১০ নম্বর বহরমপুর কেন্দ্রে ভোট অনুষ্ঠিত হয়। এমন অবাধ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন মুর্শিদাবাদ জেলায় বহুদিন দেখা যায়নি। মানুষ নিজের ভোট নিজে দিয়েছে।ছাপ্পা ভোট বা বুথ দখলের ঘটনা ঘটেনি।গত শতকের নব্বইয়ের দশক থেকে প্রায় প্রতিটি নির্বাচনে বেশ কিছুদিন ধরে মারধর, খুনোখুনি, লুটপাট চলাই এই জেলায় নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সেখানে এবার প্রায় দুই মাস ধরে এই জেলায় ভোটের প্রচার চললেও কোনো উল্লেখযোগ্য সহিংস ঘটনা ঘটতে দেখা গেল না। এটা মুর্শিদাবাদ জেলার মানুষের একটা বড় সাফল্য।
      ১৮তম লোকসভা নির্বাচনে গোটা দেশেই ভোট প্রদানের হার যথেষ্ট কম। নির্বাচন কমিশন বিভিন্ন ভাবে ভোটারদের প্রতি ভোট প্রদানের আহ্বান জানালেও তাতে খুব একটা কাজ হয়নি। পরিযায়ী শ্রমিকরা ভোট দেওয়ার উদ্দেশ্যে বাড়ি ফেরেননি। বাড়িতে থেকেও ভোট গ্রহণ কেন্দ্রে না যাওয়া মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। ফলে গণতন্ত্রের বৃহত্তম উৎসবকে কেন্দ্র করে আয়োজনের অভাব না থাকলেও নাগরিকদের অংশগ্রহণে ঘাটতি থেকে গেছে। তবে এর মধ্যেও পোলিং পার্সেন্টেজ দিক থেকে পশ্চিমবঙ্গ দেশের মধ্যে প্রথম আর মুর্শিদাবাদ জেলা রাজ্যের মধ্যে প্রথম দিকে অবস্থান করছে। এই জেলায় কমবেশি ৭৫ শতাংশ ভোট পড়েছে। তিনটি কেন্দ্রেই ভোটারের সংখ্যা আঠারো লক্ষের আশেপাশে। পুরুষ ভোটার মহিলা ভোটারের থেকে ১ শতাংশ বেশি।
      ৪ঠা জুন ভোট গণনা হবে। গণনার তিন-চার সপ্তাহ আগে মুর্শিদাবাদ জেলায় ভোট গ্রহণ শেষ হয়েছে। এখন এ কদিন সম্ভাব্য ফলাফল নিয়ে আন্দাজ, অনুমান ও মনে হওয়া চলতে থাকবে কারণ গণনার আগে নির্দিষ্ট করে কোনো কিছু বলা খুব কঠিন। মাঠে ময়দানে ঘুরে যারা ভোটের প্রচার করেন বিভিন্ন দলের সেই সব নেতাকর্মীদের দাবি সাধারণত পরস্পর বিরোধী হয়ে থাকে। কখনও তারা মানুষের মনোভাব বুঝতে ব্যর্থ হন এবং সেজন্য ভোটের হিসাব কষতে ভুল করেন। আবার কখনও জেনে বুঝেই ভুল হিসাব পেশ করেন। অনেক সময় বিভিন্ন সংস্থার 'স্যাম্পল' সংখ্যাও এত কম থাকে যে, সেই সমীক্ষার ফলাফল ভোটের প্রকৃত ফলাফলের সঠিক পূর্বাভাস দিতে পারে না। 'গবেষণা' ও গণনার ফলাফলে বিস্তর ফারাক ঘটতে দেখা যায়। এখন তো দলের প্রচারে সমীক্ষার নামে বিকৃত তথ্য পরিবেশন করাও হচ্ছে।
       লোকসভা, বিধানসভা, পঞ্চায়েত-পৌরসভা প্রতিটি নির্বাচনের প্রেক্ষিত পৃথক। এজন্য এই তিনটি স্তরের নির্বাচনে কোনো দলই কোনো নির্দিষ্ট জায়গায় একই রকম ভোট পায় না, বাড়ে-কমে। দল, প্রার্থী, পরিস্থিতি বিবেচনা করে ভোটাররা ভোট দেন। পরিস্থিতির পরিবর্তনে ভোটারদের ভাবনা পাল্টায়। তবে মানুষ গুরুতর কারণ ছাড়া সাধারণত প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার থেকে স্থিতাবস্থার পক্ষেই বেশি থাকে। মানুষ যাকে দায়িত্ব দেয় তাকে দায়িত্ব পালনের জন্য সময়ও দিতে চায়। এজন্য একই ব্যক্তি একাধিক বার জেতেন অথবা একই দল একাধিকবার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। কোনো জনপ্রতিনিধি কিংবা সরকার ইতিবাচক কাজ করতে না পারার জন্য যে জনপ্রিয়তা হারায় তার চেয়ে বেশি হারায় নেতিবাচক কাজ করার জন্য। বিশেষ ভালো কাজ না করলেও চলবে কিন্তু মন্দ কাজ করলে তাতে মানুষ আপত্তি করবে। রাজনীতিতে মানুষের মধ্যে সাধারণত এই প্রবণতাই লক্ষ্য করা যায়। তবে সাম্প্রতিক নিয়োগ দুর্নীতির অভিযোগ শাসকদলের নির্বাচনী লড়াইকে খুব কঠিন করে তুলেছে বলে মনে হচ্ছে না। বরং এই লোকসভা নির্বাচনেও মমতা ব্যানার্জির সরকারের বিভিন্ন জনমুখী প্রকল্পের কথা সাধারণ মানুষকে বলতে শোনা যাচ্ছে। 
       ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে জঙ্গিপুর কেন্দ্রে ১৩ লক্ষ (৮১ শতাংশ) ভোট পোল হয়। তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থী খলিলুর রহমান ৫ লাখ ৬২ হাজার (৪৩ শতাংশ) ভোট পেয়ে বিজয়ী হন। বিজেপি ৩ লাখ ১৭ হাজার (২৪ শতাংশ) ভোট পেয়ে দ্বিতীয় স্থান দখল করে। ভোটের ব্যবধান ছিল ২ লাখ ৪৫ হাজার। জাতীয় কংগ্রেস ও সিপিআই(এম) আলাদা ভাবে লড়ে। তাদের মিলিত ভোটের পরিমাণ ছিল ৩ লাখ ৫০ হাজার (২৬ শতাংশ)। ২০২১ সালে জঙ্গিপুর লোকসভার অন্তর্গত সাতটি বিধানসভা কেন্দ্রেই সামগ্ৰিকভাবে ৫৫ শতাংশ ভোট পেয়ে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থীরা জয়লাভ করেন।বাম-কংগ্ৰেসের মিলিত ভোটের পার্সেন্টেজ ১০ শতাংশে নেমে আসে। ২০২৩ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস একটু খারাপ ফল করে এবং ছ'টি পঞ্চায়েত সমিতির দখল নেয়। লালগোলা পঞ্চায়েত সমিতিতে বোর্ড গঠন করে বাম-কংগ্ৰেস। ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে ১৩ লক্ষের (৭৩ শতাংশ) মতো ভোট পড়েছে। পুরুষ ভোটের তুলনায় মহিলা ভোট বেশি পোল হয়েছে।তৃণমূল কংগ্রেস পূর্ববর্তী তিনটি নির্বাচনের মতো দাপট দেখাতে পারেনি। শতাংশের বিচারে তাদের ভোট নিশ্চিতভাবেই কমবে। বিজেপির ভোট আর বাড়বে না। তবে বাম-কংগ্ৰেস জোটের বাড়বে। তারা দু'একটি বিধানসভা এলাকায় লিড পাবে। জঙ্গিপুর লোকসভা কেন্দ্রে মোটামুটি ৭০ শতাংশ মুসলমান ও ৩০ শতাংশ হিন্দু ভোটার। হিন্দু ভোটের তিন-চতুর্থাংশ পাবে বিজেপি। বাকি এক-চতুর্থাংশ টিএমসি ও জোটের মধ্যে ভাগ হবে। মুসলিম ভোটের ৫০ শতাংশ টিএমসি, ৪৫ শতাংশ জোট এবং ৫ শতাংশ আই এস এফ, এস ডি পি আই সহ অন্যান্য নির্দল প্রার্থীরা পাবেন। জেন্ডারের দিক থেকে দেখলে টিএমসি বাম-কংগ্ৰেস ও বিজেপির থেকে মহিলা ভোট অনেক বেশি পাবে।সামগ্ৰিক ভাবে তৃণমূল কংগ্রেস, জোট ও বিজেপি প্রার্থী যথাক্রমে মোটামুটি ৩৫, ৩০ ও ২৫ শতাংশ এবং অন্যান্যরা ১০ শতাংশ ভোট পেতে পারে। হার-জিতের মার্জিন ৫০ হাজারের বেশি হবে না। 
   বিগত লোকসভা নির্বাচনে মুর্শিদাবাদ কেন্দ্রে তৃণমূল কংগ্রেসের  বিদায়ী সাংসদ তথা এবারেরও প্রার্থী আবু তাহের খান পান ৬ লক্ষ ৪ হাজার ভোট। বামফ্রন্ট ও জাতীয় কংগ্রেস পৃথক ভাবে লড়েছিল। তাদের মিলিত ভোটের সংখ্যা ছিল ৪ লক্ষ ৫৮ হাজার। বিজেপি পেয়েছিল ২ লক্ষ ৪৭ হাজার ভোট। ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে এই এলাকার আসনগুলোর একটি বিজেপি ও ছ'টি জেতে টিএমসি। টিএমসি ও বিজেপির ভোট বেড়ে হয় যথাক্রমে ৭ লাখ ৭৫ হাজার ও ২ লাখ ৮৪ হাজার।বাম-কংগ্ৰেসের ভোট কমে হয় ৪ লাখ ১৮ হাজার। ২০২৩ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে অবশ্য তৃণমূলের একাধিপত্য দেখা যায়নি এবং বাম-কংগ্ৰেস জোটের রাজনৈতিক শক্তি ও ভোট বৃদ্ধি পেয়েছে। এখানে মুসলিম ও হিন্দু ভোট যথাক্রমে ৮০ ও ২০ শতাংশ।এবারের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি মুর্শিদাবাদ বিধানসভা এলাকায় টিএমসি ও বাম-কংগ্ৰেস জোটের থেকে বেশি ভোট পাবে, তবে সামগ্ৰিক ভাবে তারা এক-দুইয়ের লড়াইয়ে থাকবে না, তৃতীয় স্থান নিয়েই তাদের খুশি থাকতে হবে।বাম-কংগ্ৰেসের জোট প্রার্থী সিপিআই(এম)-এর রাজ্য সম্পাদক মহঃ সেলিম ভোটের প্রচারে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। সিপিআই (এম)-এর সমস্ত শাখা সংগঠনের নেতৃবৃন্দ দিনরাত খেটেছেন। জাতীয় কংগ্রেসের নেতাকর্মীরাও সেলিম সাহেবকে ভালো ভাবে গ্ৰহণ করেছেন। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর রঞ্জন চৌধুরী চৌধুরী সেলিম সাহেবের সঙ্গে একাধিক সভায় বক্তৃতা করে জান বাজি রেখে লড়াই করার আহ্বান জানিয়েছেন।প্রচণ্ড আগ্রহ, উচ্ছ্বাস ও উদ্দীপনা সহকারে জোটের সক্রিয় সমর্থকরা ভগবানগোলা থেকে করিমপুর চষে বেড়িয়েছেন। অনেককেই বলতে শোনা গেছে, সেলিম সাহেব একজন যোগ্য লোক, তাঁর সংসদে যাওয়া উচিত। তিনি ভালো মিডিয়া কভারেজ পেয়েছেন।অন্যদিকে আবু তাহের খানের প্রচারে তেমন ঝাঁঝ দেখা যায়নি। তাঁর শারীরিক অসুস্থতা সহানুভূতি পাওয়ার বদলে মানুষের মনে প্রশ্ন তুলেছে। দ্বিমুখী লড়াইয়ে মহঃ সেলিমের জয়ের সম্ভাবনা উজ্জ্বল। মুর্শিদাবাদ লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত ভগবানগোলা বিধানসভার উপনির্বাচনে বাম-কংগ্ৰেসের জোট প্রার্থী আঞ্জু বেগম জয়লাভ করবেন।
       বহরমপুর লোকসভা কেন্দ্রে অধীর রঞ্জন চৌধুরী ১৯৯৯ সাল থেকে সাংসদ রয়েছেন। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে তিনি ৫০ শতাংশ ভোট পান এবং ৩ লাখ ৫৪ হাজার ভোটের বিশাল ব্যবধানে জয়লাভ করেন। ২০১৯ সালে সেই ব্যবধান কমে হয় ৮০ হাজার আর ভোট পার্সেন্টেজ ছিল ৪৫।তিনি সাতটি বিধানসভা ক্ষেত্রের মধ্যে বহরমপুর, কান্দি ও বড়ঞায় লিড পান আর রেজিনগর, বেলডাঙা, নওদা ও ভরতপুরে তাঁর ডেফিসিট ছিল। ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে টিএমসি'র দখলে যায় ছয়টি আসন। বহরমপুর আসনটি জেতে বিজেপি, জাতীয় কংগ্রেসের প্রার্থী মনোজ চক্রবর্তী থার্ড পজিশন পান। এই পরাজয়ের পূর্বে কিন্তু মনোজবাবুর জয়ের হ্যাট্রিক ছিল। ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের নিরিখে টিএমসি, বিজেপি ও জাতীয় কংগ্রেসের প্রাপ্ত ভোটের পরিমাণ যথাক্রমে ৬ লক্ষ ৪১ হাজার, ৪ লক্ষ ৩১ হাজার ও ২ লক্ষ ৫ হাজার। অর্থাৎ টিএমসি'র ভোট বিজেপি ও কংগ্রেসের যৌথ ভোটের থেকেও বেশি। ২০২৩ সালের বিধানসভা ও বিভিন্ন পৌরসভার নির্বাচনেও কংগ্রেসের ভোট কিংবা সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধির উল্লেখযোগ্য প্রমাণ মেলেনি।বহরমপুর লোকসভা কেন্দ্রে মুসলিম ও হিন্দু ভোট যথাক্রমে ৫৫ ও ৪৫ শতাংশ। বিজেপির প্রার্থী বিশিষ্ট চিকিৎসক নির্মল সাহা। টিএমসি'র প্রার্থী বিশিষ্ট ক্রিকেটার ইউসুফ পাঠান।প্রতিষ্ঠা ও পরিচিতির দিক থেকে তিনজনই 'হেভিওয়েট'।পাঠান ও ডাক্তার সাহার সমর্থনে তাঁদের দলের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ বারবার প্রচারে এসেছেন। কিন্তু অধীর চৌধুরীর সমর্থনে কংগ্রেসের কোনো বড় নেতাকে প্রচারে আসতে দেখা যায়নি। হাতের কাছেই সিপিআই(এম)-এর মহঃ সেলিম ছিলেন। কিন্তু তাঁকেও বোধহয় ডাকা হয়নি। অধীর চৌধুরী নিজের মতো করে দু'-একজন স্থানীয় নেতা নিয়ে প্রচার সেরেছেন। আসলে অধীর বাবু প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসী। তিনি  নিজেকে 'একাই একশো' মনে করেন।ব্যক্তিগত ক্যারিশমার জোরে ভোটে জেতার কথা ভাবতে ভালোবাসেন। ভোটের পাটিগণিতে অধীরবাবুর জেতার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। তাঁর জেতার জন্য ভোটের রসায়ন দরকার। এই রসায়ন অনুযায়ী গত পাঁচ বছর ধরে যারা বিজেপিকে ভোট দিচ্ছিল তাদের অর্ধেক আর টিএমসি'কে যারা ভোট দিচ্ছিল তাদের এক-তৃতীয়াংশ যদি এবার অধীরবাবুকে ভোট দেন তবেই তিনি জিততে পারেন। এতো ভোট একজন ব্যক্তির জন্য স্বতঃস্ফূর্তভাবে সুইং করা সাধারণভাবে সম্ভব নয়।এক্ষেত্রে অধিকাংশ জায়গাতেই বিজেপি ও টিএমসি'র আঞ্চলিক বা বুথ স্তরের নেতাকর্মীদের অন্তর্ঘাত করতে হবে। কিন্তু সেটা কি সম্ভব? বাম আমলে গোটা জেলা জুড়ে অধীর চৌধুরীর যে দাপট ছিল টিএমসি'র জমানায় তা কিন্তু নেই। তাঁর 'রবিনহুড' হওয়ার পর্বে যারা তাঁর পাশে ছিলেন আজ তারা তাঁর বিরোধী।বহরমপুর শহরের মধ্যেও তাঁকে একাধিকবার 'গো ব্যাক' স্লোগান শুনতে হয়েছে। পরিস্থিতি খুব কঠিন। তীব্র ত্রিমুখী লড়াইয়ে পাঠান ছক্কা মারবেন নাকি ডাক্তারবাবু অস্ত্রোপচারে সফল হবেন নাকি 'অধীর দা' ডবল হ্যাট্রিক করবেন জানা যাবে ৪ঠা জুন।

১০:১২ এএম, ১৬ মে ২০২৪ বৃহস্পতিবার

রাজনৈতিক প্রচার ও তার প্রতিক্রিয়া

রাজনৈতিক প্রচার ও তার প্রতিক্রিয়া

রাজনৈতিক প্রচার ও তার প্রতিক্রিয়া 

মজিবুর রহমান, প্রধানশিক্ষক, কাবিলপুর হাইস্কুল 

 

     রাজনীতি হল নীতিগত লড়াইয়ের সর্ববৃহৎ মঞ্চ।রাজ্য বা রাষ্ট্র পরিচালনা তথা 'জনগণের সেবা' করার উপযোগী নীতি-আদর্শ নিয়ে রাজনৈতিক দল গঠিত হয়। লক্ষ্য এক হলেও পথ পৃথক হওয়ার জন্য আলাদা আলাদা দল তৈরি হয়ে থাকে। দলের ঘরোয়া বৈঠকে সেই পথ ও পন্থা সম্পর্কে আলোচনা করা হয়।আজকাল অবশ্য মতাদর্শের কথা বলার থেকে বিরোধী দলের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাল্টা অভিযোগ তোলার প্রবণতাই বেশি পরিলক্ষিত হয়।এই অভিযোগ পাল্টা অভিযোগের পথ ধরেই পার্টির প্রচারের কাজ এগিয়ে চলে। কিন্তু এই ধরনের প্রচারে মানুষ কতটুকু প্রভাবিত হয়? অভিযুক্ত ব্যক্তি বা দলের ওপর মানুষের মনোভাবে কতটুকু পরিবর্তন ঘটে? একটুখানি অনুসন্ধান করা যাক।

     জন্মলগ্ন থেকেই বিজেপি একটা মুসলিম বিরোধী হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক দল। স্বভাবতই বিরোধীরা বিজেপির বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িকতা তথা ধর্মের নামে বিভাজনের রাজনীতি করার অভিযোগ করেন।এই অভিযোগ একাধিকবার প্রমাণিতও হয়েছে। কিন্তু এর ফলে কি তারা রাজনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে? তেমন তো মনে হয় না।এটা ঠিক যে, হিন্দুত্ববাদী দল হওয়ার কারণে বিজেপিকে মুসলমানরা সাধারণত ভোট দেন না। বিজেপি বোধহয় মুসলমানদের ভোট প্রত্যাশাও করে না। তবু তারা জেতে।এর একটা সহজ গাণিতিক হিসাব রয়েছে। ঠিক যে কারণে বিজেপি মুসলমানদের ভোট পায় না ঠিক সেই কারণেই হিন্দুদের একটি অংশের ভোট ভোট পেয়ে থাকে। দেশের অধিকাংশ কেন্দ্রে ৮০ শতাংশ হিন্দু ভোটারের অর্ধেকের সমর্থন পাওয়াই বিজেপির জয়লাভের জন্য যথেষ্ট। সে লক্ষ্যেই তারা কর্মসূচি গ্ৰহণ করে এবং সফল হয়।কাজেই দেশের অহিন্দুদের জন্য বিজেপি কতটা মারাত্মক তার কাহিনী শুনিয়ে ভোটের রাজনীতিতে বিজেপিকে আটকানো সম্ভব নয়। বরং দেশবাসীর অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ মনন তৈরি করার ওপর জোর দেওয়া দরকার যাতে মানুষ কোনো সম্প্রদায়ভিত্তিক দলকেই সমর্থন না করে।একাজ করতে হলে ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দলগুলোর নেতানেত্রীদের ধর্মের ব্যাপারে নির্মোহ হতে হবে। ধর্মপালনকে ব্যক্তিগত স্তরে আবদ্ধ রেখে প্রকাশ্য ধর্মানুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত থাকতে হবে।দলবল নিয়ে মন্দিরে পুজো, মাজারে চাদর দেওয়া, ইফতারে অংশ নেওয়া বন্ধ করতে হবে।কৌশল হিসেবে নরম হিন্দুত্বকে আশ্রয় করা চলবে না।মনে রাখতে হবে, ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলোর পক্ষে নরম হিন্দুত্বকে হাতিয়ার করে বেশি সংখ্যায় হিন্দু ভোট পাওয়া সম্ভব নয়। হিন্দুদের যে অংশটা সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে ভোট দেয় তারা সত্যিকারের হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপিকেই দেবে। নতুন করে রাম নবমী'তে ছুটি দিয়ে অথবা দিঘায় জগন্নাথ মন্দির নির্মাণ করে টিএমসি বিজেপির কাছ থেকে হিন্দু ভোট ছিনিয়ে নিতে পারবে না। হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার তাস খেলে বিজেপিকে হারানো যাবে না।বরং বিজেপির হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা বাড়তে পারছে মুসলিমপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো সম্পর্কে ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলোর নরম মনোভাবের কারণে।যেমন, পীরজাদা নওসাদ সিদ্দিকীর আই এস এফ একটি সম্প্রদায়ভিত্তিক দল যার বেড়ে ওঠায় কয়েকজন বামপন্থী নেতার ভূমিকা অস্বীকার করা যায় না। ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে টিএমসি'র পেছন থেকে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সমর্থন সরানোর লক্ষ্যে ধর্মীয় নেতা আব্বাস সিদ্দিকীকে মদত দেওয়া হয়েছিল।আই এস এফ'কে সঙ্গে নিলে টিএমসি'র দুর্নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলনে জোর আসতে পারে কিন্তু বিজেপির সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াইটা দুর্বল হয়ে পড়ে।এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গে মুসলিমপন্থী আই এস এফের অস্তিত্ব যত প্রকট হচ্ছে হিন্দুত্ববাদী বিজেপির শক্তি তত বৃদ্ধি পাচ্ছে।সাম্প্রদায়িক দলের সঙ্গে ধর্মনিরপেক্ষ দল একসাথে বেশিদিন চলতেও পারে না। ১৯৮৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে জাতীয় স্তরে বিজেপির সঙ্গে এক মঞ্চে অবস্থান আর রাজ্যে আই এস এফের সঙ্গে তিন বছরের বন্ধুত্বের ফল বামেদের পক্ষে ভালো হয়নি কিন্তু ওই দুই সাম্প্রদায়িক দল অনেক লাভবান হয়েছে। মমতা ব্যানার্জি বিজেপির প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ীর মন্ত্রিসভার সদস্য থেকেছেন, একাধিকবার জোট বেঁধে ভোটে লড়েছেন।আজ যখন রাজ্যে প্রধান প্রতিপক্ষ হয়ে উঠেছে তখন বিজেপির বিরুদ্ধে টিএমসি'র সাম্প্রদায়িকতার অভিযোগের গুরুত্ব থাকে না।বিজেপির বিরুদ্ধে বিভিন্ন দলের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বানেই বা কতটুকু আন্তরিকতা থাকে? দেশ নয় দলীয় স্বার্থেই সাধারণত জোট বাঁধার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করা হয়।তাই বিজেপি বিরোধী জোটের জট কখনও কাটে না এবং লোকসভা নির্বাচনেও স্থানীয় ইস্যু তুলে জাতীয় ইস্যুকে লঘু করে দেওয়া হয়। পশ্চিমবঙ্গ সহ একাধিক রাজ্যে সেটাই ঘটতে দেখা যাচ্ছে। 

     টিএমসি'র দুর্নীতি নিয়ে বিরোধীরা সকলেই সোচ্চার।উঠতে বসতে টিএমসি'কে চোর বলা হচ্ছে। দুর্নীতির অভিযোগে টিএমসি'র বেশ কয়েকজন নেতাকর্মী জেল খাটছেন। দলটির দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নেতা অভিষেক ব্যানার্জিকে এখনও পর্যন্ত জেলবন্দি করতে না পারার আক্ষেপ ও অসন্তোষ প্রতি মুহূর্তে ঝড়ে পড়ছে বিরোধী দলের নেতৃবৃন্দ সহ কলকাতা হাইকোর্টের একাধিক বিচারপতির কণ্ঠে। মেইন স্ট্রিম প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় শাসকদলের দুর্নীতি নিয়ে তীব্র সমালোচনা চলছে। ২০২১ সালে মমতা ব্যানার্জি তৃতীয় বারের মতো সরকার গঠনের কয়েক মাস পর থেকে দুর্নীতি নিয়ে যত কথা হয়েছে, টিএমসি'র নেতাকর্মীদের বাড়িতে যতবার ইডি, আইটি, সিবিআই তল্লাশি চালিয়েছে, যত টাকা পয়সা বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে স্বাধীন ভারতে পশ্চিমবঙ্গ তো বটেই অন্য কোনো রাজ্যেও এমন ঘটনা কখনও ঘটেনি। গত আড়াই-তিন বছর ধরে সরকার ও শাসকদলের দুর্নীতি নিয়ে এতো তোলপাড় চলছে কিন্তু জনগণকে কি সাংঘাতিক ক্ষুব্ধ বা ক্ষিপ্ত হতে দেখা যাচ্ছে?মনে তো হচ্ছে না। চাকরি বাকরি করেন, ব্যবসা থেকে ভালো উপার্জন হয়, আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য আছে, দেশ কাল সমাজ নিয়ে চিন্তা ভাবনা করার অবকাশ পান এমন মানুষের সংখ্যা শতকরা কুড়ি-পঁচিশ জন। বাকি পঁচাত্তর-আশি ভাগ মানুষই দু'মুঠো রুজি রুটির ব্যবস্থা করতে প্রতিদিন ব্যস্ত থাকেন। হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করেন। তাঁদের অধিকার নিয়ে ভাবার অবকাশ নেই। এদিক ওদিক থেকে সরকারি বেসরকারি যেকোনও অনুদান, ভাতা পেলে তাঁরা খুশি হন। যারা তা দেয় তাদের প্রতি তাঁরা কৃতজ্ঞতা প্রদর্শন করেন। তাঁরা নেতানেত্রীদের গাড়ি বাড়ি বিষয় সম্পত্তি নিয়ে মাথা ঘামান না। সাধারণভাবে মনে করেন, যে যায় লঙ্কা সে হয় রাবণ। কাজেই দুর্নীতি করার কারণে টিএমসি'র জনসমর্থনে সাংঘাতিক ধস নেমেছে এমনটা বলা যাবে না। 

     আসলে দুর্নীতির একটা সামাজিকীকরণ ঘটে গেছে। সমাজ জীবনের সর্বত্র তা ছড়িয়ে পড়েছে। দুর্নীতি আজ আর কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়; প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পরিগ্রহ করেছে।সংগঠিতভাবে বা চেইন সিস্টেমে সম্পন্ন হচ্ছে।সিংহভাগ মানুষই কোনো না কোনোভাবে দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত।যার যেমন ক্ষমতা সে তেমন দুর্নীতি করে। অনেস্টি ইজ দ্য বেস্ট পলিসি- এই প্রবচন ক'জন ব্যক্তিগত জীবনে প্রয়োগ করে? বাস্তব সত্য হল, আজকের সমাজ ব্যবস্থায় সৎ থাকাটাই কঠিন।সততা নিয়ে চলার জন্য যে মানসিক দৃঢ়তা ও উন্নত আদর্শবোধ থাকা দরকার তা খুব বেশি জনের পক্ষে অর্জন করা সম্ভব হয় না।যেমন, হাজার হাজার চাকরিপ্রত্যাশী নিজেরা লাখ লাখ টাকা শাসকদলের নেতাকর্মীদের হাতে তুলে না দিলে এতবড় নিয়োগ দুর্নীতি হওয়া সম্ভব ছিল না। এঁরা সবাই এই দুর্নীতির স্টেকহোল্ডার। দুর্নীতির কারণে যাঁরা চাকরি পাননি তাঁরা যদি শাসকদলের বিপক্ষে থাকেন তবে অবৈধভাবে যাঁরা চাকরি পেয়েছেন তাঁরা শাসকদলের পক্ষে আছেন। অর্থাৎ দুর্নীতির অভিযোগে ভোটের অঙ্কে শাসকদলের খুব একটা ক্ষতি হচ্ছে না। যেভাবে বিভিন্ন পেশাজীবীদের দুর্নীতির শৃঙ্খল স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে সেভাবেই নেতানেত্রীদের দুর্নীতি এখন আর অস্বাভাবিক ঘটনা বলে মনে করা হয় ন। এটা সর্বসাধারণের গুরুতর মানসিক অবক্ষয়।এই মানসিক অবক্ষয় রোধ না হলে দুর্নীতিগ্ৰস্ত দল বা নেতানেত্রীদের ভোটে ভরাডুবি হবে না। ভোটের রাজনীতিতে সৎ রাজনীতিকরা কোনো বাড়তি সুবিধা পাচ্ছেন না। তাঁরা শ্রদ্ধা, ভালোবাসা পান কিন্তু ভোট পান না। আসলে যা হওয়া উচিৎ বলে মনে করা হয় বাস্তবে তা অনেক ক্ষেত্রেই হয় না।

       'শত্রুর শত্রু মিত্র' ফর্মুলা অনেকসময়ই বুমেরাং হয়ে দেখা দেয়। পশ্চিমবঙ্গে বাম-কংগ্ৰেসের জন্য পদত্যাগী বিচারপতি তথা বিজেপি প্রার্থী অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় এই ঘটনার সাম্প্রতিক উদাহরণ। উনি নিয়োগ দুর্নীতির বিচার প্রক্রিয়ায় নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় কাজ করছিলেন কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই তা নিয়ম মেনে করা হচ্ছিল না।রীতি ভেঙে সংবাদমাধ্যম দীর্ঘ সাক্ষাৎকার দিলেন। রাস্তাঘাটে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করলেন। রাজনৈতিক দলের শাখা সংগঠনের মঞ্চে গিয়ে বক্তৃতা দিলেন। এজলাসে বসে অতিরিক্ত অবান্তর কথা বলতেই থাকলেন। পদ ও প্রতিষ্ঠানের ওপরে ওঠার অপচেষ্টা অব্যাহত রইলো।তবু তাঁর প্রশংসা ও স্তুতি হতেই থাকল কারণ তখন তিনি রাজ্য সরকার ও শাসকদলের বিরুদ্ধে 'প্লেয়িং টু দ্য গ্যালারি' খেলছিলেন। সেই তিনি বামেদের বুড়ো আঙুল দেখিয়ে 'পারিবারিক পার্টি' জাতীয় কংগ্রেসের অস্তিত্ব খুঁজে না পেয়ে তৃণমূলকে দংশন করতে 'বেলেবোরা' হয়ে বিজেপি'তে যোগদান করলেন। তিনি আজ গান্ধী ও গডসের মধ্যে একজনকে বেছে নিতে পারেন না। আদালতের 'ভগবান' রাজনীতিতে এসে 'শয়তান' হলেন।বিচিত্র ভারতে বোধহয় রাজনীতির মতো বিচিত্র অন্য কিছুই নেই।

(লেখকের নিজস্ব মতামত)

০৮:৪৮ এএম, ২৩ এপ্রিল ২০২৪ মঙ্গলবার

জঙ্গিপুরে শাহাজান বিশ্বাস এর পাল্লা ভারী

জঙ্গিপুরে শাহাজান বিশ্বাস এর পাল্লা ভারী

আইএসএফের জঙ্গিপুর লোকসভা কেন্দ্র প্রার্থী শাহজাহান বিশ্বাস বিদায়ী সংসদ তৃণমূল নেতা খলিলুর রহমানের ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছেন একথা আমজনতা বলতে শুরু করেছে। আইএসএফের প্রতীকে জঙ্গিপুর লোকসভা কেন্দ্র থেকে জীবনের প্রথম বারের নির্বাচনে দাঁড়িয়ে কার্যত তৃণমূলের জেতার পথে বড় কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছেন এ বারে। টুয়েলভে ফেল সিনেমা অনেকেরই দেখা কিন্তু এবার লোকসভা ভোটে মাধ্যমিকের গণ্ডি না পেরিয়েও জঙ্গিপুরেেব টেক্কা দেবে আই এফ এফ এর শাহজাহান বিশ্বাস এমনই মনে করছেন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা। বৃহস্পতিবার সকালে নিজের বাসভবন থেকে বেরিয়ে গঙ্গা নদী পেরিয়ে সোজা চলে যান লালগোলা বিধানসভা কেন্দ্রের আইরমারি কৃষ্ণপুর, দেওয়ানসরাই, লালগোলা, নশিপুর, বাহাদুরপুর, জসাইতলা, মানিকচক, পাইকপাড়া, বিল্বরাকোপরা, কালমেঘা ও রামচন্দ্রপুর গ্রাম পঞ্চায়েত গুলি সহ লালগোলা পন্ডিতপুর গাবতলা মুক্ত কারাগার এলাকার বিভিন্ন জায়গায় হুড খোলা গাড়ি নিয়ে ঘুরতে দেখা গেল। লড়াইয়ের ময়দানে নামা তেজি ঘোড়া শাহজাহান মাথার উপর ঠাটা রোদ আর জঙ্গিপুরের প্রার্থীর ভোটের লড়াই দুটোই টেক্কা দিচ্ছে তৃনমূল প্রার্থীকে। মানুষ কিভাবে রাস্তায় বেরিয়ে আই এস এফ এর প্রার্থী শাহজাহান বিশ্বাসকে আশীর্বাদ করছেন না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না।

১১:৩০ পিএম, ১৮ এপ্রিল ২০২৪ বৃহস্পতিবার

বৈষ্ণবনগর জুড়ে অবৈধভাবে চলছে গ্যাস রিফিলিং

বৈষ্ণবনগর জুড়ে অবৈধভাবে চলছে গ্যাস রিফিলিং

০৭:৪৪ পিএম, ১ এপ্রিল ২০২৪ সোমবার

তৃনমূল ছেড়ে কংগ্রেসে যোগদান সিউড়ির বৈঠকে

তৃনমূল ছেড়ে কংগ্রেসে যোগদান সিউড়ির বৈঠকে

আগামী ২০২৪ এর লোকসভা ভোটকে পাখির চোখ করে সমস্ত রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের রণকৌশল ঠিক করে মাঠে ময়দানে অবতীর্ণ।সেইসাথে শুরু হয়েছে ঘর ভাঙা গড়ার খেলা।

১০:২৭ পিএম, ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ রোববার

ঝরে শ্মশান কালী মেলার শুভ উদ্ধোধন, কাঁকরতলা এলাকায়

ঝরে শ্মশান কালী মেলার শুভ উদ্ধোধন, কাঁকরতলা এলাকায়

০৯:৫১ পিএম, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ শনিবার

মানিকচকে পথ অবরোধ করে বিক্ষোভ জয় হিন্দ বাহিনীর

মানিকচকে পথ অবরোধ করে বিক্ষোভ জয় হিন্দ বাহিনীর

০২:০৬ পিএম, ৮ অক্টোবর ২০২৩ রোববার

Puspaprovat Patrika
এই বিভাগের জনপ্রিয়