শবেবরাত ২০২৫: অভিবাসন ও গাজা নিপীড়ন
খগেন্দ্রনাথ অধিকারী
পুষ্পপ্রভাত পত্রিকা
প্রকাশিত : ০৯:৫৭ এএম, ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ রোববার

শবেবরাত ২০২৫: অভিবাসন ও গাজা নিপীড়ন
খগেন্দ্রনাথ অধিকারী
বুৎপত্তিগতভাবে শবে বরাত কথাটি ফরাসী শব্দ "শব" এবং "বরাত" (অর্থাৎ রাত এবং সৌভাগ্য)--এই দুই-এর যোগফল। এক কথায় শবেবরাত শব্দের অর্থ হোল সৌভাগ্যের রাত। মুসলিম ভাইবোনদের কাছে তো বটেই, হিন্দু--মুসলিম--বৌদ্ধ--খৃশ্চান, জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে, সারা পৃথিবীর সকল ধর্মনিরপেক্ষ তথা বহুত্ববাদী মানুষদের কাছে এই দিনটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং আবেগ জড়িত দিন: এই দিনটি হোল পরম শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের দিন। ধর্মপ্রাণ মুসলিম ভাইবোনেরা এই দিনটিতে প্রার্থনা করেন তাঁদের প্রয়াতঃ স্বজনদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে, প্রার্থনা করেন তাঁদের করা "গুনাহ" অর্থাৎ অন্যায় কাজের জন্য মার্জনা চেয়ে।
মনে রাখতে হবে যে প্রতিটি ধর্মীয় পার্বনের দুইটি দিক আছে। বস্তুবাদীরা মানেন না বটে, কিন্তু এটাই বাস্তব যে এই ধরণের অনুষ্ঠানের একাধারে আত্মিক (আধ্যাত্মিক) ও সামাজিক দিক আছে। কি খৃষ্টীয় পার্বন বড়দিন, কি হিন্দু পরব দ্বীপান্বিতা, কি মোমিন ভাইদের শবেবরাত, সব কিছুরই এই দুইটি দিক আছে। শবেবরাতের আত্মিক প্রসঙ্গ আগেই উল্লেখ করেছি। বড়দিনে খৃশ্চান ভাইবোনরা "মা মেরী" ও "লর্ড যীশু"-কে স্মরণ করে তাঁদের আশীর্বাদ চান। দীপান্বিতাতে হিন্দু ভাইবোনরা দীপ জ্বেলে পিতৃপুরুষের স্মরণ করেন এবং তাঁদের আশীর্বাদ চান। বলা বাহুল্য যে শবেবরাতের রাতে মুসলিম ভাইবোনদের মাজারে দীপ জ্বালানোর সাথে দীপাবলীর রাতে হিন্দু ভাইবোনদের বা বড়দিনের রাতে খৃশ্চান ভাইবোনদের আলোকসজ্জা করার গভীর মিল রয়েছে।
এই আত্মিক মিলের পাশাপাশি এইসব পরবের একটি বিশাল সামাজিক তাৎপর্যও আছে। তথাকথিত আগ মার্গা বামপন্থী বা কমিউনিস্টরা এইসব পার্বনকে পাত্তাই দেন না। কার্লমার্কস্ তাঁর সময়কালে খৃশ্চান পাদ্রীরা জার্মানীসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে "মুক্তিপত্র" বিক্রিকরে যে ব্যবসা করতো এবং সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষরা "পাপের হাত থেকে রেহাই পেতে" যেভাবে টাকা দিয়ে সেগুলো কিনতো, তাই দেখে ক্ষুব্ধ কার্লমার্কস্ লিখেছিলেন "Religion is the opium of the masses" অর্থাৎ ধর্ম আফিঙ। কিন্তু এই ধর্মের যে একটা প্রচণ্ড সামাজিক দিকও আছে, সেটাও তিনি স্বীকার করেছেন এবং সেই জন্যই তিনি বিয়ে করেছিলেন চার্চে গিয়ে। বিয়ের সামাজিক দিক তথা এক্ষেত্রে চার্চের সামাজিক ভূমিকাকে তিনি অস্বীকার করতে পারেননি।
১৯১৭ সালে অক্টোবর বিপ্লবের পর বলশেভিক পার্টিতে তুমুল বিতর্ক ওঠে যে গীর্জা মসজিদ, মঠ মন্দির এইসব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলি সম্পর্কে বলশেভিক সরকারের নীতি কি হবে। ট্রটস্কি প্রমুখ বাম হঠকারীরা মার্কসের উল্লিখিত উক্তির দোহাই পেড়ে সমস্ত ধর্মস্থানগুলিকে ভেঙ্গে দেবার উপরে তথা ধর্মীয় পর্বগুলি পালনের উপরে নিষেধাজ্ঞা জারির কথা বলেন। অন্য দিকে প্লেখানভ, পটারেসব প্রমুখ দক্ষিণপন্থী সংশোধনবাদীরা বলেন যে সমস্ত ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও ধর্মাচারণের তথা ধর্মীয় পার্বন পালনের সকল সুযোগকে বলশেভিক সরকার পূর্ণ সুযোগ দেবে। কমরেড লেনিন ও কমরেড যোসেফ স্টালিন এই উভয় বক্তব্যকেই খারিজ করে একটি তৃতীয় বিকল্পের কথা বলেন। সেটি ছিল এই যে কোনরকম ধর্মীয় মতান্ধতা ও কুসংস্কারকে তথা ধর্মীয় মৌলবাদকে বলশেভিক সরকার প্রশ্রয় দেবে না। তবে ধর্মাচরণের অধিকার তথা ধর্মীয় পরব পালনের অধিকারকে এই সরকার সম্মান করবে। আবার সেই সঙ্গে সঙ্গে ধর্মাচরণ না করার অধিকারকেও বলেশেভিক সরকার কুর্নিশ করবে।
বস্তুতঃপক্ষে লেনিন সংবিধান, স্টালিন সংবিধান ও ব্রেজনেভ সংবিধানে একইসঙ্গে এই দুই অধিকার স্বীকৃতিলাভ করে। সোভিয়েত ইউনিয়নের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে সেখানে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ক্ষুধা, দারিদ্র্যও বেকারী দূর হওয়ার ফলে শবেবরাত বা ঈদেলফেতরে ভিক্ষা বা দান নেবার মত কোন লোককে পাওয়া যেতো না। তাই সরকার রাষ্ট্রীয় ভাণ্ডার খুলে দিত দান বা ফেতরা গ্রহণের জন্য। সেই দান বা ফেতরার অর্থ দিয়ে সরকার জনসেবামূলক কাজ করতো।
যাই হোক আমরা এখানে ২০২৫ সালের শবেবরাতের প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা করছি। প্রত্যেক বারের মতো এ বছরও এই পবিত্র দিনে মোমিন ভাই বোনেরা প্রার্থনা করবেন। কিন্তু এ বছরে তাঁদের প্রার্থনার একটা বিশেষ দিক রয়েছে এবং সেই দিকটি হোল গাজাসহ সারা বিশ্বে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের মদতে ইসরায়েলসহ তার উচ্ছিষ্টভোগীরা রক্তের বন্যায় ভাসিয়ে দিচ্ছে। তাই এই দানবদের শাস্তি হোক এবং জর্ডানের তীরে গাজার প্রান্তরে ধ্বংসস্তূপের উপর সৃষ্টির কিশলয় পল্লবিত হোক, এটাই হবে প্রার্থনা।
সমাজতান্ত্রিক-অসাজতান্ত্রিক নির্বিশেষে বিশ্বের সকল দেশের ধর্মপ্রাণ মুসলিম ভাইবোনেরা এবং সেই সঙ্গে ধর্মনিরপেক্ষ সমস্ত স্তরের মানুষরা সুস্থ সুন্দর বিশ্বের স্বপক্ষে এবং দানবীয় শক্তির বিনাশের জন্য প্রার্থনা করেন। এখানে প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ বারে বারে তার কায়েমী স্বার্থে মুসলিম দুনিয়াকে এই বলে বিভ্রান্ত করেছে বা করার চেষ্টা করেছে যে বামপন্থীরা ধর্ম মানে না বা ধর্মীয় পরবকে মান্যতে দেয় না। এই বলে তুরস্ক সংকটকালে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের অব্যবহিত পরে আমেরিকার রাষ্ট্রপতি ট্রুম্যানের মদতে হাজার হাজার বামপন্থী মুসলিম, মৌলবাদীদের হাতে খুন হয়েছেন।
প্রায় সমসাময়িককালে মিশরের রাষ্ট্রপতি আব্দেল নাসেরকে বামপন্থীদের বিশেষ করে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের বন্ধু হবার জন্য, মুসলিম ব্রাদরহুড নামে একটি মৌলবাদী মুসলিম সংগঠন মার্কিন মদতে খুন করার চেষ্টা করে। অভিযোগ তাঁর বিরুদ্ধে যে তিনি সাচ্চা মুসলিম নন। অথচ জাতিধর্ম নির্বিশেষে বিশ্বের সকল প্রান্তের নিপীড়িত জনতার পাশে থেকেছেন নাসের সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে। তুরস্কের কমিউনিস্টরা জননেতা ও কবি নাজিম হিকমতের নেতৃত্বে ধর্মীয় মৌলবাদের বিরুদ্ধে লড়েছেন এবং ইসলামের মধ্য যে মানবতাবাদের নির্যাস রয়েছে, সেটিকে তুলে ধরেছেন। ইসলামী সংস্কৃতি তথা পার্বনগুলির সুস্থ-সুন্দর সম্প্রীতিবাদী দিকগুলির উপর জোর দিয়েছেন।
বিগতশতাব্দীর সত্তরের দশকের শেষভাগে আফগানিস্থানে যে সাউর বিপ্লব হয়, তার কর্ণধাররা, বিশেষতঃ বারবাক কারমাল ও ডঃ নজিবুল্লাহ ধর্মীয় মতান্ধতার বিরুদ্ধে লড়েছেন। তাঁরা ইসলাম ও ইসলামী পরবের যে মানবতাবাদী মহান মুখ, তা তুলে ধরেছেন সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার মাধ্যমে। অথচ আমেরিকা সেখানকার প্রতিবপ্লবী শক্তিগুলিকে মদত করে রক্তের বন্যায় কাবুলকে ভাসিয়ে দিয়েছে, রাষ্ট্রপতি ডঃ নজিবুল্লাকে নিষ্ঠুরভাবে খুন করিয়েছে। আবার যে লাদেনকে সৃষ্টি করে সে আফগানিস্থানে এই তাণ্ডব করেছে, সেই লাদেনকেই সে খুন করেছে পাকিস্থানে বিমান হানা করে।
পরিশেষে, মুখে আমেরিকা ধর্ম ধর্ম বলে, কমিউনিস্ট ও বামপন্থীদের নাস্তিক বলে। অথচ পবিত্র ঈদের ভোরে এই আমেরিকা ইরাকী প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনকে ফাঁসি দিয়েছে এবং তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে মুখর হয়েছে বামপন্থী ও কমিউনিস্টরা।
পরিশেষে বলতে চাই যে মার্কিনযুক্ত রাষ্ট্রে দ্বিতীয়বারের জন্য ডোনাল্ড ট্রাম্প রাষ্ট্রপতি হিসাবে নিযুক্ত হবার পর হোয়াইট হাউসের বর্বরতা আরও বেড়েছে। হিংস্র পশুর চেহারা নিয়ে সে ভারত, মেক্সিকো, কলম্বিয়া সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অভিবাসীদের বিতাড়ন করছে। গাজা থেকে সমস্ত মুসলিম ভাইবোনদেরকে উৎখাত করার জন্য সে তেল আবিভকে প্রকাশ্যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এইসব দানবীয়তা ধ্বংস হোক এবং সত্য, ন্যায় ও মানবিক মূল্যবোধের জয় হোক, এটাই হবে এই ২০২৫ এর শবেবরাতের প্রার্থনা।
লেখক পরিচিতি
অধ্যাপক খগেন্দ্রনাথ অধিকারী রাষ্ট্রীয় বিদ্যাসরস্বতী পুরস্কার ও এশিয়া প্যাসিফিক পুরস্কার সহ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বহু পুরস্কার প্রাপ্ত একজন খ্যাতনামা শিক্ষাবিদ। ইনি কোলকাতার সাউথ সিটি (দিবা) কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ।
ঠিকানা-শরনিয়ার বাগান
পোষ্ট-টাকী, পিন-৭৪৩৪২৯
পশ্চিমবঙ্গ, ভারত
*লেখকের কাছ থেকে মোঃ ইজাজ আহামেদ - এর দ্বারা সংগ্রহ করা হয়েছে*