সম্প্রীতি
পুষ্পপ্রভাত পত্রিকা
প্রকাশিত : ০৩:২৫ পিএম, ২০ অক্টোবর ২০২৪ রোববার
সম্প্রীতি
খগেন্দ্রনাথ অধিকারী
"সম্প্রীতি" বলে একটি সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর তরফে শারদীযা দূর্গোৎসবে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণের উপর ষষ্ঠী থেকে মণ্ডপে মণ্ডপে ঘুরে একটা সার্ভে চলছে। আজ মহা অষ্টমী। এই গোষ্ঠীর দু'জন তরুণ, দীপেশ ও রমেশ এসেছে বিবেকানন্দ ক্লাবে ক্যামেরা ও ডাইরী হাতে সমীক্ষা করতে। অন্যান্য মণ্ডপের মতো এখানে আলোর রোশনাই নেই। ছিমছাম মার্জিত মণ্ডপ। কিন্তু যে জিনিষটা ওদেরকে খুব আকৃষ্ট কোরলো সেটা হোল প্যাণ্ডেলে ঢোকার মুখে পাশাপাশি বসে আছেন দুই বিপরীত পোষাকের বৃদ্ধ। একজন দীর্ঘদেহী টুপি মাথায়, মুখ ভর্তি পাকা দাড়ি সাদা পাজামা পাঞ্জাবী পরা একজন ব্যক্তি, অন্যজন ধূতি পাঞ্জাবী পরিহিত। আর্দ্দির পাঞ্জাবীর গলা দিয়ে তাঁর পৈতে ও দু-কণ্ঠী মালা দেখা যাচ্ছে। দু-জনেই চারিদিকে চোখ রেখে গল্প করছেন।
একদিনে শতাধিক মণ্ডপে দীপেশ--রমেশরা ঘুরেছে। কিন্তু, কোথাও এই দৃশ্য দেখেনি। ওঁদেরকে বুঝতে না দিয়ে একটু দূর থেকে দীপেশ পটাপট ওঁদের ছবি তুলে নিল। এরপর দু'জনে ওদের কাছে এসে নমস্কার দিয়ে বলল--"কিছু মনে না করলে জ্যেঠু আপনাদের দু--জনের একটা ইন্টারভিউ নেবো। আমরা একটা সমীক্ষা করছি "সম্প্রীতি" সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর তরফ থেকে।
দু'জনেই সহাস্যে উত্তর দিলেন--কোন আপত্তি নেই বাবা। কিন্তু আমাদের মত এই আশি ছুঁই ছুঁই বৃদ্ধদের নিয়ে সাক্ষাৎকারে তোমাদের কি হবে?
--আশি ছুঁই ছুঁই বয়েস জ্যেঠু!" রমেশ জিজ্ঞেস কোরলো।
--হ্যাঁ বাবা। বিশ্বাস হচ্ছে না বুঝি?
--দেখে তো মনে হচ্ছে, আপনাদের এখনো ষাট পুরিনি।
--হাঃ হাঃ হাঃ। আমরা হলাম দুই বাল্য সহপাঠী। কর্ম জীবনেও একই হাইস্কুলে শিক্ষকতা করতাম। অবসর গ্রহনের পর নিয়মিত হাঁটি, ব্যায়াম করি। আর স্বল্পাহার করি। এটাই আমাদের এই স্বাস্থ্যের রহস্য।
এবার দীপেশ মুখ খুললো-- জ্যেঠু যদি আপানাদের নাম দুটো Kindly বলেন!
--আমি রমেন ভট্টাচার্য্য। সংস্কৃত পড়াতাম স্কুলে। আর উনি হলেন হাজী সালাউদ্দিন রহমান। Arabic-এর শিক্ষক ছিলেন।
--দারুণ। দারুণ জ্যেঠু। আপনাদের মত এমন জুটি কোন মণ্ডপেই পাইনি।
--তার মানে বাবা?
--তারমানে একজন হলেন সংস্কৃতজ্ঞ ব্রাহ্মণ। আর একজন হলেন আরবীজ্ঞ হাজী মানুষ। দুজনে পাশাপাশি পূজো মণ্ডপে!
--তাতে কি বাবা?
--কিছু না জ্যেঠু। অশোক--আকবর--বিবেকানন্দ--রবীন্দ্রনাথ--নজরুলের দেশে এটাই তো আমাদের পরম্পরা। এটাই তো হওয়া উচিৎ। কিন্তু এখন তো পরিবেশটা পাল্টে গেছে। আমরাও জ্যেঠু বাবা, মা, শিক্ষক, শিক্ষিকা গুরুজনদের কাছ থেকে ছেলেবেলায় শিখেছি কি ঈদ, কি বড়দিন, কি দূর্গা পুজো, কি দীপাবলী--এগুলো হোল মিলন উৎসব। এইগুলোতে হিন্দু--মুসলিম--খৃশ্চান নির্বিশেষে কোলাকুলি করেছি, মিষ্টি, রুটি পিঠে, পায়েস, কেক পরস্পরের বাড়ীতে গিয়ে কাকীমা--জ্যেঠিমা--ঠাকুরমা--দাদীমা--খালামা--চাচীমা--আন্টিগ্রামীদের হাতে খেয়েছি। এখন সেসব উঠে গেছে।
--ঠিক বলেছো বাবা। এখন সব কিছুর সংকীর্ণ ধর্মায়ণ হচ্ছে। সব কিছুর দুর্বৃত্তায়ন হচ্ছে।
--যা বলেছেন জ্যেঠু।
--তাই তো আমরা এই দুই বৃদ্ধ আমাদের ক্লাবের নাসির, জাকির, যোসেফ--তপন--তাপস সবাইকে উৎসাহিত করে পূজো কমিটি করে দিয়েছি। মাথার উপরে আছেন তোমাদের জ্যেঠু হাজী সাহেব। আর আমি ওয়ার্কিং প্রেসিডেন্ট। করিম হচ্ছে সম্পাদক। মানস হচ্ছে সহ-সম্পাদক। এছাড়া অন্যান্যরা তো আছেই।
-- Exceptional, Exceptional জ্যেঠু।
--এই পূজোয় আপনাদের প্রোগ্রাম কি একটু বলুন না Please।
--দেখো বাবা! আমরা পূজোটাই করি, সম্প্রীতির বন্ধনটাকে জাতিধর্ম নির্বিশেষে দৃঢ় করার দিকে নজর রাখি। আর সাধ্যমত, চেষ্টা করি এবং এবারও করেছি দুঃস্থদের মধ্যে বস্ত্র, চাল, ও ত্রিপল বিলির। অতিবর্ষণে বিপন্ন মানুষদের পাশে সাধ্যমত থেকেছি এবং এখনো চেষ্টা করছি।
একটু থেমে ভট্টাচার্য্য বাবু বললেন--বরাবরই আমরা প্যাণ্ডেল, আলোকসজ্জা ইত্যাদির পেছনে যতটা সম্ভব কম খরচ করি। এবারও করেছি। তার উপর অতিবর্ষণ তো আছেই। এছাড়া আর একটা দিকও আছে।
--কি সেটা জ্যেঠু?
--অভয়া কাণ্ড। তার উপর যে নারকীয় অত্যাচার হয়েছে তার প্রতিবাদে আমরা বিন্দুমাত্র আতিশয্য করিনি এবং সরকারী অনুদানও নিইনি। নিজেরা, হিন্দু--মুসলিম ভাইবোনরা চাঁদা তুলে এই পূজো করছি। আমার এই সতীর্থ হাজী ভাই তো তাঁর একমাসের পেনশানের টাকা দিয়ে দিয়েছেন। অথচ উনি কিন্তু মোটেও খুব স্বচ্ছল নন।
--সত্যিই, এটা একটা দৃষ্টান্তযোগ্য ঘটনা।
--না না বাবা। এই বলে আমায় লজ্জা দিও না। আমিও সতীর্থ ভট্টাচার্য্য বাবু সাধারণ মানুষ। সাধারণ মানুষের বিবেচনায় যেটা করা উচিৎ, সেইটাই করেছি মাত্র।
--আচ্ছা জ্যেঠু! কিছু মনে না করলে আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি?
--স্বচ্ছন্দে।
--আপনি একজন হাজী মানুষ। আপনি মূর্তি পূজোয় চাঁদা দিচ্ছেন। তার পূজো কমিটিতে আছেন। এসব নিয়ে আপনার Community-তে আপনাকে সমস্যায় পড়তে হয় না?
--দেখো বাবা! সব সম্প্রদায়ের মধ্যে ইদানিং মৌলবাদী চিন্তাধারা বেড়েছে। আগে এসব ছিল না। সে যাই হোক। আমরা ওসব মানবতার স্বার্থে থোড়াই কেয়ার করি। এই যে আমার সতীর্থ, মানে তোমাদের এই ভট্টাচার্য্য জ্যেঠু সহ অনেক হিন্দু ভাইবোনই তো আমাদের ইছালে ছওয়াবে চাঁদা দেন, উনি তো এই গ্রামের ইছালে ছাওয়াব কমিটির সভাপতি হন।
--বাঃ। বাঃ। কি চমৎকার। দেশটাকে বাঁচাতে, বজরংবলীওয়ালা, সিয়ারাম ওয়ালা, জামাতিইসলামী ওয়ালাদের হাত থেকে এই বাংলা, এই ভারতকে বাঁচাতে এটাই তো চাই।
একটু থেমে রমেশ ভট্টাচার্য্য বাবুর দিকে ফিরে ও প্রশ্ন কোরলো--জ্যেঠু, আজ তো অষ্টমী। আপনাদের এখানে কুমারী পূজো হয়েছে?
--না হয়নি। বলতে পারো, আমার জন্যেই হয়নি।
--কেন? কেন?
--কুমারী পূজোর চল স্বামীজীই করেছিলেন। এর আগে এটা ছিল না। ১৮৯৮ সালে স্বামীজী ঝিলাম নদীর এক মুসলিম মাঝির চার বছরের কিশোরী কন্যা তার ক্ষুধার্ত ছোট্ট ভাইটির মুখে তার নিজের খাবারটুকু তুলে দিতে দেখে তাকে ভারতমাতাজ্ঞানে পূজো করেছিলেন, তাকে প্রণাম করেছিলেন। সেই থেকেই কুমারী পূজার চল। স্বামীজী বহুত্ববাদী সংস্কৃতির দেশ ভারতবর্ষে এই পূজোর মাধ্যমে একটা বার্তা দিয়েছিলেন। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বার্তা। আমি কয়েক বছর ধরে বলে আসছি আমরাও মহা অষ্টমীতে কুমারী পূজো কোরবো। কিন্তু সেটা হবে ঠিক স্বামীজীর আদলে একটি মুসলিম কিশোরীর পূজো।
--এতো জ্যেঠু দারুণ Idea !
--কিন্তু বাবা, আমি বা তোমার এই হাজী জ্যেঠু ব্যর্থ হয়েছি। তার কারণ, মুসলিম সমাজ থেকে বিচ্যূত হতে হবে, মেয়েটিকে হয়তো বিয়ে দেওয়া যাবে না। এই ভয়ে কোন মুসলিম ভাইবোন, তোমার হাজী জ্যেঠু শত বোঝানো সত্ত্বেও মুসলিম মৌলবাদীদের ভয়ে তাঁদের কিশোরী কন্যাকে দিতে চাননি। অন্যদিকে, মুখে বিবেকানন্দের প্রতি ভক্তি দেখালেও অধিকাংশ হিন্দু পরিবার চায়নি যে কুমারী পূজোয় কোন মুসলিম কিশোরীকে পূজো করা হোক। তাদের বক্তব্য ছিল যে বেলুড় মঠে তো কুমারী পূজো হয় হিন্দু ঘরের কিশোরীকে নিয়ে। মুসলিম কিশোরীকে নিয়ে নয়। কাজেই হিন্দু কিশোরীকে রেখেই কুমারী পূজো হোক। এ নিয়ে আমার ও আমার সহমতাবলম্বীদের সঙ্গে তাদের তীব্র মতান্তর হয়। আমরা বলতে বাধ্য হই যে আমরা বেলুড় মঠের কাছ থেকে স্বামীজী বা তাঁর আদর্শ শিখবোনা। আমরা আমাদের শিক্ষা--দীক্ষা ও জ্ঞানবুদ্ধি দিয়ে স্বামীজীর ভাবাদর্শ বিচার ও তার রূপায়ণ করবো। এই বিতর্কের প্রেক্ষাপটে গোটা কুমারী পূজো বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত হয়, যদিও পূজো কমিটির সভাপতি হিসাবে তোমাদের এই হাজী জ্যেঠু সবাইকে অনুরোধ করেছিলেন যে ঐক্যমত হয়ে হিন্দু ঘরের কোন কিশোরীকে নিয়ে বেলুড় মঠের মত আমাদের এখানেও কুমারী পূজো হোক। কিন্তু, আমার ও আমার সহমতাবলম্বী বেশকিছু হিন্দু ভাইবোনদের তীব্র আপত্তিতে কুমারী পূজোর পরিকল্পনা পরিত্যক্ত হয়। আমরা বলি হয় মুসলিম কিশোরীর পূজো হবে, নইলে কুমারী পূজো হবে না।
--জ্যেঠু, আপনাদের দু'জনকে যে কি বলে শ্রদ্ধা জানাবো! এখানে এসে, আপনাদের কাছে এসে এই প্রত্যয় দৃঢ় হয়েছে যে এ রাজ্যে, এ দেশে শেষ কথা বলবে সংকীর্ণ ধর্মান্ধরা নয়, শেষ কথা বলবে আপনাদের মত উদার ধর্মনিরপেক্ষ মানুষরা এবং আপনাদের মত উদার ধর্মনিরপেক্ষ মানুষরা এবং আপনাদের অনুগামীদের অস্তিত্ব শুধু আমাদের এই দু'জনের সত্তায় নয়, এই ক্লাবের অনেকের সত্তায়, তরুণ প্রজন্মের অনেকের সত্তায় আছে। এ দেশ ও এ রাজ্যের মানবতার ভবিষ্যৎ এইখানে।
একটু থেমে তরুণ সমীক্ষকটি বললো
--খুব খুশী হলাম জ্যেঠু আপনাদের সাথে কথা বলে।
--আরও খুশী হবে একটু ভিতরে গিয়ে আমাদের ছেলেদের আঁকা ছবিগুলো দেখলে।
ওরা দুজনে ভিতের গেলো। বিস্ময় ভরা চোখে দেখলো ছবিগুলো একে একে (১) ঝিলাম নদীর মাঝির মেয়েকে স্বাজীজী পূজো করছেন; (২) গোরক্ষিনী সভার সম্পাদককে স্বামীজী বলছেন "গোমাতার সন্তান" না হলে, গোরুর পেট থেকে না পড়লে তারা কি গোরু বাঁচানোর জন্য এমন কথা বলে জোরাজুরি করে। (৩) গোমাংস খাবার অপরাধে উত্তরপ্রদেশে আখলাখ হত্যার ও হরিয়ানার পশ্চিমবাংলার পরিযায়ী শ্রমিক সাবির হত্যার ছবি। (৪) গো সেনাদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে ধর্ম নিরপেক্ষ হিন্দু মুসলমানদের প্রতিবাদের ছবি, (৫) প্যালেস্টাইনে মার্কিন মদতপুষ্ট ইসরায়েলের গণহত্যার ছবি, (৬) দেশে দেশে মার্কিন--ইসরায়েলী হানার বিরুদ্ধে শান্তিকামী ও স্বাধীনতাকামী মানুষের প্রতিবাদী সমাবেশের ছবি।
বেরিয়ে এসে ওরা দু'জনে ওঁদের উদ্দেশ্যে বললো--মনটা ভরে গেলো জ্যেঠু অমূল্য সম্পদে। অনুমতি করুন, এবারে আমরা আসি।
--এসো বাবা।
--দুই বৃদ্ধকে প্রণাম করে ওরা রওনা দিল। হালকা সুরে তখন মাইকে বাজছে গান--
আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার
চরণ ধূলার তলে।
আকাশে তখন কাস্তের ফলার মতো অষ্টমীর চাঁদের কলা দেখা দিয়েছে।
লেখক পরিচিতি
অধ্যাপক খগেন্দ্রনাথ অধিকারী রাষ্ট্রীয় বিদ্যাসরস্বতী পুরস্কার ও এশিয়া প্যাসিফিক পুরস্কার সহ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বহু পুরস্কার প্রাপ্ত একজন খ্যাতনামা শিক্ষাবিদ। ইনি কোলকাতার সাউথ সিটি (দিবা) কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ।
ঠিকানা-শরনিয়ার বাগান
পোষ্ট-টাকী, পিন-৭৪৩৪২৯
পশ্চিমবঙ্গ, ভারত