রোববার   ২৪ নভেম্বর ২০২৪   অগ্রাহায়ণ ১০ ১৪৩১   ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ফাতেহা দোয়াজ দাহাম ও ফাতেহা ইয়াজ দাহামের দিনে বিশ্ব মানবতার উত্তোরণে হোক দোয়া

খগেন্দ্রনাথ অধিকারী

পুষ্পপ্রভাত পত্রিকা

প্রকাশিত : ০৮:৩১ এএম, ১৫ অক্টোবর ২০২৪ মঙ্গলবার

ফাতেহা দোয়াজ  দাহাম ও ফাতেহা ইয়াজ দাহামের  দিনে  বিশ্ব মানবতার উত্তোরণে হোক দোয়া

খগেন্দ্রনাথ অধিকারী

আরবিতে ফতেহা শব্দের অর্থ হোল প্রার্থনা বা দোয়া। আর দোয়াজ দাহাম শব্দের অর্থ একসাথে বারোর প্রার্থনা। মহানবি হজরত মহম্মদের জন্মদিন হিসাবে এই দিবসটি পালন করা হয়। উল্লেখ্য যে ইসলাম ধর্মে জন্মদিন বা মৃত্যুদিনকে আড়ম্বর সহকারে পালনের বিধান নেই। অত্যন্ত অনাড়ম্বরভাবে মহানবির এই জন্মদিনটিকে বিশেষ প্রার্থনা, দোয়ার মাধ্যমে তাই উদ্‌যাপন করা হয়। ইংরাজী ৫৭০ মতান্তরে ৫৭১ খৃষ্টাব্দে মা ফতেমার গর্ভ থেকে মহানবি মক্কার এক পাহাড়ী উপত্যকায় জন্মগ্রহণ করেন। আসলে আরবি মাস "রবিউল আউয়াল"-এর ১২ তারিখে সোমবার হজরত মহম্মদ জন্মগ্রহণ করেন। তাই এই দিনের প্রার্থনাকে বারোর প্রার্থনা বা "ফতেহা দোয়াজ দাহাম" বলা হয়।
আর একটি কথা। "রবিউল" শব্দের আরবিতে অর্থ হোল বসন্ত বা চিরসবুজ। ইসলামী বিশেষজ্ঞরা বলেন যে মক্কাসহ গোটা আরব ভূখণ্ড ছিল মরুময়। কিন্তু মা ফতেমার গর্ভে মহানবি আসার সময় থেকে গোটা প্রাকৃতিক পরিবেশ সেখানে পাল্টে যায়। সবুজে সবুজে গোটা এলাকা ভরে যায়। গাছে গাছে দেখা দেয় রকমারী ফুল ও ফলের সমারোহ। মহানবির পবিত্র জন্মদিনে তাই বিশ্বজুড়ে ধর্মপ্রাণ মুসলিম ভাই বোনরা সর্ব্বশক্তিমানের কাছে দোয়া করেন, প্রার্থনা করেন বিশ্ববাসীর সুখ--শান্তি সমৃদ্ধির জন্য, ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত এক পৃথিবীর জন্য। এবারেও, এই ২০২৪ সালেও, ফতেহা দোয়াজ দাহামে তার কোনই অন্যথা হবে না।
অনেকেই ফতেহা দোয়াজ  দাহাম ও ফতেহা ইয়াজ দাহাম এই দুইটিকে এক করে  ফেলেন।ইয়াজ দাহাম কিন্তু ফরাসী শব্দ ।এর অর্থ হলো এগারোতম দিন ।এটি হোল হজরত কাদের জিলানির ওফাত দিবস।হিজরি পাঁচশ একষট্টি সালের এগারোই রবিউস সানি ওনার এন্তেকাল হয়।তাঁর স্মরণে বিশ্বজুড়ে এইদিন  প্রার্থনা করেন শান্তি ও সম্প্রীতির জন্য ।পনেরোই অক্টোবর দুহাজার চব্বিশে এবারে সেই ফতেহা  ইয়াজ দাহামের দিন।আর দুহাজার চব্বিশ সালের ষোলই সেপ্টেম্বর ছিল ফতেহা দোয়াজ দাহামের দিন।
আমরা জানি যে আমরা আজ এই একবিংশ শতাব্দীতে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিদ্যার বিস্ময়কর বিজয় যাত্রার যুগে বসবাস করছি। তবুও আমরা বোলবো যে মহানবি হজরত মহম্মদের ৫৭০/৫৭১ খৃষ্টাব্দে জন্মের পূর্ববর্তী সময়কাল ও আজকের যুগের তুলনামূলক বিচারে
কিম্বা পরমপূজ্য হজরত কাদের জিলানির পাঁচশ একষট্টি হিজরিতে ওফাত দিবসের বিচারে, ক্ষুধা--দারিদ্র্য--বেকারী--হানাহানি, ইত্যাদির দৃষ্টিকোণে, আমরা এখন মোটেও কোন ভালো অবস্থায় নেই। বরং বলা যায় যে আমরা বাহ্যিক দৃষ্টিতে অনেক উন্নততর অবস্থানে থাকলেও, আজো আমরা কার্যতঃ পড়ে আছি প্রাক--মহানবি--জন্মকালের আগের পরিস্থিতির মধ্যে। কি আমাদের রাজ্যপরিস্থিতি, কি আমাদের জাতীয় পরিস্থিতি, কি আমাদের বিশ্বপরিস্থিতি, সব কিছুর নিরীখে আমরা এই কথাই বলতে পারি।
প্রথমেই আমরা ধরি আমাদের রাজ্য পশ্চিমবাংলার অবস্থার কথা। আমাদের কবি দ্বিজেন্দ্রলাল রায় লিখেছিলেন--
"ধনধান্যে পুষ্পে ভরা,
আমাদের এই বসুন্ধরা।"
কিন্তু সেই "ধনধান্যে পুষ্পে ভরা বসুন্ধরা" আজ শশ্মানে পরিণত হয়েছে। কৃষি--শিল্প সমস্ত কিছুই আজ শেষ। বেকারীর পাহাড় এই রাজ্যে। হাজারো রকমের "ডোল" দেওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে অমূক শ্রী তমুক শ্রী ইত্যাদির নামে। সীমাহীন দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়ণ আজ এই রাজ্যে। দুর্বৃত্তদের হাতে মানুষ মরছে প্রতিদিন নির্বিচারে। দুর্নীতি জেনে ফেলেছিল বলেই আর. জি. কর মেডিক্যাল কলেজের তরুণী চিকিৎসককে খুন হতে হয়েছে। আজও তার কিনারা হয়নি। সরকারের প্রচার মাধ্যমে দুবেলা বলা হচ্ছে উন্নয়ন, উন্নয়ন। আমাদের জানতে ইচ্ছা করে এই উন্নয়ন কার উন্নয়ন? এই উন্নয়ন কি রিজওয়ানুয়ের বাবার উন্নয়ন? এই উন্নয়ন কি হরিয়ানার গোরক্ষকদের হাতে নিহত পশ্চিমবাংলার পরিযায়ী শ্রমিক সাবিরের পরিবারের উন্নয়ন? এই উন্নয়ন কি সিঙ্গুরে জমিহারা কৃষকদের উন্নয়ন অথবা যে তরুণরা রাজ্যে শিল্পায়ণের মাধ্যমে তাদের কর্মসংস্থানের স্বপ্ন দেখেছিল, এ উন্নয়ন কি তাদের উন্নয়ন? মোটেও তা নয়। এই উন্নয়ন হোল কিছু গোরু চোর, কয়লা চোর, বালি চোর, সোনা চোর, চাকরি চোর, মেছোঘেরীর মালিক, ইটভাঁটার মালিক, প্রোমোটার ও কনট্রাকটরদের উন্নয়ন। তারা রাতারাতি আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ হচ্ছে। আর সাধারণ মানুষ দিন দিন আরও নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে। শাসকগোষ্ঠী কখনো সংখ্যালঘু তোষণ, কখনো সংখ্যাগুরু তোষণের মাধ্যমে হিন্দু--মুসলিমে বিভাজন তৈরী করে রাজ্যে ক্ষমতায় আছে। তাদের পুতনা রাক্ষসী রাজে কর্মহীন মানুষরা এরাজ্য ছেড়ে রুটি রুজির সন্ধানে ভিন রাজ্যে যাচ্ছে। সেখানে গিয়ে অপুষ্টি, অর্ধাহার, অস্বাস্থ্যকর কাজের পরিবেশ, ইত্যাদিতে কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়ে কেউ কেউ মারা যাচ্ছে অকালে। আবার কেউ কেউ উগ্র ধর্মীয় মৌলবাদীদের আক্রমণের শিকার হয়ে লাশ হয়ে ফিরে আসছে শ্মশান শয্যায় বা গোরস্থানে।
তাই এবারে ফতেহা ইয়াজ দাহামে বা দোয়াজ দাহামে মোমিন ভাইদের প্রার্থনা হবে পশ্চিমবাংলা যেন ধাপ্পাবাজি "লক্ষ্মীরভাণ্ডার"-এ পরিণত না হয়ে সত্যিকারের লক্ষ্মীর ভাণ্ডারে পরিণত হয়। যেন কৃষি, শিল্প, সামাজিক পরিবেশ সব কিছুতেই এই রাজ্যে মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরী হয় এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির প্রকৃত বাতাবরণের আবহে যেন কবিগুরুর পদধূলি ধন্য বাংলা "সোনার বাংলা"য় পরিণত হয়। সমৃদ্ধিতে পশ্চিমবাংলা আগামী দিনে ভরে উঠুক, এটাই হোক এই দুই দিবসের আবেদন ।
ঠিক একইভাবে এই পবিত্র দিনদুইটিতে সর্ব্বশক্তিমানের কাছে তাঁদের প্রার্থনা হোক ভারতের স্থিতি, স্থায়িত্ব, ও সমৃদ্ধি নিয়ে। ইতিহাস সাক্ষ্যদেয় যে আমাদের এই মহানদেশ একা হিন্দুর নয়, একা মুসলমানের নয়, একা খৃষ্টানের নয়, এই দেশ হোল হিন্দু--মুসলিম--বৌদ্ধ--খৃষ্টান সকলের। বহুত্ববাদী সংস্কৃতির যে ধারা অশোক--আকবর--দারাশিকো--বিবেকানন্দ--রবীন্দ্রনাথ--কাজী নজরুল প্রমুখের হাতে সমৃদ্ধ হয়েছে, সেই ধারা আজ আমাদের দেশে বিপন্ন। আমাদের দেশে আজ চলছে ধর্মীয় মেরুকরণের রাজনীতি। ফলে এদেশে আজ মানুষ গৌণ। মুখ্য হোল তার ধর্মীয় পরিচয়। কোথাও এখন এই আসমুদ্রহিমাচল ভারতবর্ষের কোথাও কোথাও  একজন মানুষের জীবনের চেয়ে একটি গোরুর মূল্য অনেক বেশী। কোথাও রামের নামে, কোথাও রহিমের নামে হচ্ছে নির্মম নিষ্ঠুর গণহত্যা। আমাদের জন্মভূমি ভারতবর্ষ এই গভীর সংকটের হাত থেকে মুক্ত হোক এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পরিমণ্ডল পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হোক, এটাই হোক সকল মোমিনের দোয়া।
আমাদের দেশ ঐতিহ্যগতভাবে বরাবর সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী, বর্ণ বৈষম্যবাদ বিরোধী ও ঔপনিবেশিকতাবাদ বিরোধী। কিন্তু সেই মহান আদর্শ থেকে বিচ্যূত হয়ে আমাদের দেশের বর্তমান সরকার এখন সাম্রাজ্যবাদীদের তাঁবেদারে পরিণত হয়েছে। এদেশের শুভবুদ্ধি সম্পন্ন সকল মানুষ জাতিধর্ম নির্বিশেষে ভারত সরকারের এই লেজুড়বৃত্তির বিরুদ্ধে লড়ছেন। তাঁদের এই লড়াই যেন সফল হয় এবং এই লড়াই-এর চাপে যেন বর্তমান দিল্লীর সরকার বিদেশনীতির ক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী অবস্থান নিতে বাধ্য হয়, এটা হোক সকলের ঐ দিন দুইটিতে নমাজের শেষে মোনাজাত।
পরিশেষে, আমাদের রাজ্য ও আমাদের দেশের মত গোটা বিশ্ব পরিস্থিতিও আজ খুব জটিল। সাম্রাজ্যবাদ ও সংকীর্ণ ধর্মীয় মৌলবাদ আজ রক্তের বন্যায় গোটা পৃথিবীকে আজ রক্তের বন্যায় ভাসিয়ে দিচ্ছে। কোথাও হিন্দু মৌলবাদ, কোথাও বৌদ্ধ মৌলবাদ, কোথাও খৃষ্টান মৌলবাদ, কোথাও ইহুদি মৌলবাদ ধর্মের দোহাই পেড়ে এই কাণ্ড করছে। মায়ানমারে বৌদ্ধ মৌলবাদীরা মুসলিম হবার অপরাধে রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের রক্তে সেদেশের মাটিকে রক্তে লাল করে দিচ্ছে। আবার সারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যথা আফগানিস্থান, সিরিয়া, আলজেরিয়া প্রমুখ দেশে উগ্র ইসলামিক মৌলবাদ ইসলামিক স্টেট নাম ধরে বা আফগানিস্থানে তালিবান নাম ধরে শুধু অমুসলিমদেরকেই নয়, সুস্থ চিন্তার মুসলিম ভাইবোনদেরকে খুন করছে। ভারতবর্ষে দিকে দিকে উগ্র হিন্দু মৌলবাদীরা খৃষ্টান ও মুসলিমদের রক্তে যমুনা--গঙ্গা--সবরমতীর তীরকে ভাসিয়ে দিচ্ছে। উত্তরপূর্ব্ব ভারতে উগ্র খৃষ্টান আধিপত্যবাদ ও উগ্র হিন্দু মৌলবাদীদের দ্বন্দ্বে মণিপুরসহ বিভিন্ন সবুজ পাহাড় আজ রক্তে লাল। সংকীর্ণ মুসলিম বিদ্বেষের দৃষ্টিকোণে উগ্র ইহুদি মৌলবাদ জর্ডানের তীর ও গাজার প্রান্তরকে লালে লাল করে দিচ্ছে মানুষের রক্তে।
মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ তার সংকীর্ণ তেলের রাজনীতির স্বার্থে ইসরায়েলকে মদত করে গোটা মধ্যপ্রাচ্যকে কেন্দ্র করে তৃতীয় মহাযুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরী করছে। ইরাণ, লেবালন প্রমুখ দেশ মানবতার বৃহত্তর স্বার্থে প্যালেস্টাইন মুক্তি সংগ্রামীদের পাশে সংগত কারণেই দাঁড়িয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ আজ প্যালেস্টাইনের পক্ষে থাকলেও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও ইসরায়েল মরীয়া হয়ে মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। লজ্জার কথা যে আমাদের দেশের ঐতিহ্যগত সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আদর্শকে জলাঞ্জলি দিয়ে ভারত সরকার ইসরায়েল ও আমেরিকার এই যুদ্ধ প্রয়াসকে সমর্থন করছে। এক কথায় বিশ্ব শান্তি ও নিরাপত্তা আজ বিপন্ন।
এই পরিস্থিতিতে গোটা পৃথিবীকে বাঁচাতে পবিত্র ফতেহা দোয়াজ দহমের ও ইয়াজ দাহামের  দিনে, এবারে মোমিন ভাইরা অবশ্যই প্রার্থনা করবেন সাম্রাজ্যবাদ ও সব রকমের ধর্মীয় মৌলবাদের নিশ্চিত পরাজয় ও মানবতাবাদ এবং বিশ্ব শান্তিরবাদের তথা প্যালেস্টাইন মুক্তি সংগ্রামের জয়ের লক্ষে, এ আমাদের দৃঢ় আশা ও প্রত্যয়।

     
লেখক পরিচিতি
অধ্যাপক খগেন্দ্রনাথ অধিকারী রাষ্ট্রীয় বিদ্যাসরস্বতী পুরস্কার ও এশিয়া প্যাসিফিক পুরস্কার সহ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বহু পুরস্কার প্রাপ্ত একজন খ্যাতনামা শিক্ষাবিদ। ইনি কোলকাতার সাউথ সিটি (দিবা) কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ।
ঠিকানা-শরনিয়ার বাগান
পোষ্ট-টাকী, পিন-৭৪৩৪২৯
পশ্চিমবঙ্গ, ভারত