সোমবার   ২৫ নভেম্বর ২০২৪   অগ্রাহায়ণ ১১ ১৪৩১   ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

গল্প - পাগলী

হাবিবুর রহমান

পুষ্পপ্রভাত পত্রিকা

প্রকাশিত : ০৪:৩৯ পিএম, ৭ জুলাই ২০২৪ রোববার

গল্প- পাগলী
 -হাবিবুর রহমান 
 বারাইপুর, কলকাতা ১৪৪

 ভোরের আলো তখনো ফোটেনি ভালোভাবে। কলিং বেল্টটা বেজে উঠল, ক্রিং ক্রিং।
 বাড়ির কর্তা সবার বড়দা।
 ফজরের নামাজের মোনাজাত শেষ করে, পড়ি মরি করে সদর দরজার তালা খুলে দিল।
 বাড়ির মেড সার্ভেন্ট খুসলিমা গজর গজর করতে করতে বাড়িতে প্রবেশ করে।
 বড়দা তারে শুধায়, এই সাত সকালে তোর আবার কি হলো রে?
 এক মুখ হেসে পাগলী কয়, নাগো বড়দা কিছু লয়, শালা চেকারটা পোঁদে লেগেছিল। তা দিনু তার মুখে ঝামা ঘষে।
 বড়দা কয়, ঝামা?সেটা আবার কিরে ?
 পাগলী কইলো, নদী নালা পার হইয়া রেতকে দিন কইরা সরকারের রেলে চরনু, গুএকোর ব্যাটা, আমারে কয়,টিকিট?
 তার চোখের উপর চোখ থুইয়া কইনু, জানোস বাপু,লোকে মোরে পাগলী কয়। সকালে মনমর্জি ভালো আছে, মানে মানে কাইট্টা পড়। নইলে এমন ঝাঁপি দুবো বাপের নাম ভুইলা যাবা ।
 চেকার বুদ্ধিমান, বুঝল মহিলার ইস কুরু ঢিলা।
 বাক্যালাপ্ না করে চেকার বাবাজি লেজ গুটিয়ে কেটে পড়লো।
 বড়দা কয়, তোদের তো কম দাম,টিকিট কাটিস না কেন?
 পাগলী ঝাঁঝালো উত্তর করল, বাঁচি থাক আমার মমতা দিদি। বিনা পয়সায় রেশন পানি দেয়, নাতিডারে মিড ডে মিলে খাতি দেয়। কই সে তো পয়সা চায় না?
 আর বড় সরকারের রেল, তার চামচা আমারে কয়,টিকট। এ মামা বাড়ির আবদার, হে চাইলে আর আমি দিয়ে দিনু?
 আর এ বাড়ির বড় গিন্নি আমারে মত্তর দেয় তিনটি হাজার টাকা। তা নেয় কত খাতে খরচ করি জানো? তোমারএতো মায়া হোলি দাও না বাপু টিকটের দামটা।
 পাগলীর তীর বড়দার দিকে দেখে, সে চুপ হয়ে যায়।
 তারপর শুরু হলো কাজ, এটো থালা-বাসন মাজা, একনাগারে টিউ কলের ঘরঘরানি।
 দুচোখ জুড়ে ঘুম আসছিল বড়দার, এই বাসন থালার আওয়াজ, টিউকলের আওয়াজে ঘুম আসে না।
 বাড়ির গিন্নি রয়েল বেঙ্গল টাইগার, জেগে উঠে হাক পারে, এই পাগলি, তুই কি বাড়ির কাউকে ঘুমাতে দিবি না নাকি?
 বাসন থানা তোর আর মাজতে হবে না। কাল থেকে তুই আর আসিস না কাজে । 
 ভয় ওই একটা লোককেই করে, সব আওয়াজ বন্ধ হয়ে গেল, মিহি করে বললে পাগলী, আচ্ছা বরবু তুমি ঘুমাও ক্যানে ।
 সকালের আলো ফুটেছে, সাতটা বাজে। পড়ি মরি করে পাগলী চলে গেল অন্য বাড়িতে কাজ করতে।
 এইভাবে ছয় সাতটা বাড়ি কাজ করতে করতে সন্ধ্যার ট্রেনে আবার বাড়ি ফিরে।
 স্বামীহারা পাগলী, এক ছেলে, এক নাতি আর বৌমাকে নিয়ে কুঁড়েঘরে  সংসার।
 ছেলেটা ঘরকুনো অলস, কাম কাজ কিছুই করেনা।
 রেগে গেলে শাপ শাপান্তি করে, কিন্তু নিজের পেটের সন্তান তো, তাকে ফেলে কেমনে।
 তাই নদী নালা সাঁতরে টাউনের বাবুদের বাড়ির এঁটকুটো থালাবাসন মেজে যে রোজগার করে, সবটা ছেলে বউয়ের পোদে লাগায়।
 শীতগ্রীষ্ম বর্ষা কোনদিন কাজে কামাই করে না পাগলি।
 কনকনে  ঠান্ডায় ঠিক ছটায় কলিংবেল বাজে। লেপের গরম ছেড়ে উঠতে বড়দার দেরি হয়। আবার কলিং বেল বাজে।
 বেজার মুখে বড়দা এসে দরজা খুলে পাগলিকে শুধায়, আচ্ছা খুসলি তোর কি ঠান্ডা লাগে না?
 হালকা চাদরটা খুলতে খুলতে পাগলী বলে, অত থেন্ডার ভয় করলি কি চলে বরদা? ওকে যত ভয় করবা ও তত তোমাকে গিলে খাবে।
 তুমি যে শুয়ে পড়ো, কাজে লেগে পড়লি দেখবা  গা গরম হয়ী যাবা।
 এই হল পাগলি।
 বাড়ির গিন্নিকে ভয় করে, আবার ভক্তিও করে।
 পাগলীর কাজে কেউ ভুল ধরতে পারবেনা, কিন্তু বড় গিন্নি ছাড়বে কেন?
 একদিন বললে, এই পাগলি এই কি তোর মাজা ঘষার ছিরি। থালা বাসনে এটো লেগে আছে ।
 আর যায় কোথায়। বেঁধে গেল কুরুক্ষেত্র।
 তা বড় গিন্নির কাছে পারবে কেন, সে সাফ বলে দিল, এই পাগলি অতো চোপরা করলে কাল থেকে তুই আর আসিস না কাজে।
 শুরু হলো কান্নাকাটি, ভাবি এ কথা তুমি বলতি পারলে? জান গেলেও মুই তোমাদের কাজে কামাই দেই না, আর ভালো করে কাম করি। সেই তুমি বাহানা খুঁজছো মোকে কাজ থেকে তেড়িয়ে দিতে।
 লেপের নিচে বড়দা উপভোগ করছে, পাগলী সেখানে যে হাজির।
 কাঁদতে কাঁদতে বললে, দেখনা বড়দা, ভাবি না -হক করে মোর সঙ্গে ঝগড়া করতেছে ।
 কেন জানিনা বড়দাকে সে খুব মানতো।
 বড়দা বললে,কান্না থামা পাগলী।
 কান্না থেমে গেল, পাঞ্জাবির পকেট থেকে পঞ্চাশ টাকার একটা নোট বের করে বড়দা  বললে, যা বাইরে দোকানে চা রুটি খেয়ে নিস।
 ব্যাস সব ঠান্ডা।
 কিন্তু পরে আমার ওপর বিস্ফোরণ ঘটলো বাড়ির রয়েল বেঙ্গল টাইগারের। আমার আশকারাতে নাকি ঝি চাকর মাথায় উঠছে.। বোবার শত্রু নেই, চুপ থাকলাম।
 একদিন সকালে পাগলীর ছেলে এসে হাজির, মার বাজজে বমি হয়েছে, নার্সিংহোমে ভর্তি আছে, টাকা লাগবে।
 বড়দা সাধ্যমত দিল টাকা।
 ওমা পরদিন পাগলী হাজির। বড়দা তারে কয়, তুই তুইতো নার্সিংহোমে ভর্তি ছিলিস , তা এতো সকালে এলি কেন?
 দুর্বল শরীর কিন্তু মুখে হাসি, এখন মুই ভালো ভালো আছি বড়দা, আমি না আসলি তোমাদের কাজটা করবে কেডা?
 তার আনুগত্য দেখে বড়দা পুলকিত।
 পৌষ মাস, মাঠের ধান ভাঙ্গিয়ে আতপ চাল করা হয়েছে পিঠা পায়েসের জন্য।
 চালের বস্তাটা নিচের ঘরে থাকে।
 একদিন তো পাগলীর দরজার তালা খুলে দিয়ে বড়দা দেঘোর ঘুমে আচ্ছন্ন।
 কাঁদতে কাঁদতে পাগলী থাকে ঠেলে তোলে, ও বড়দা বড়দা গো, আই নাকি তোমাদের আতপ চাল চুরি করিছি। বড় ভাবি আমাকে না-হক করে চোর বদনাম দিচ্ছে। মুই বাড়ি থেকে মোর বাচ্চাদের পিঠে পানা করার জন্যি আতপ চালএনেচিনু ।
 বড় ভাবি বলছে, ওই চাল নাকি  তোমাদের। মুই চুরি করেছি।  চোর বদনাম দিচ্ছে মোকে ।
 আমি আর তোমাদের বাড়ির কাজ করুম না বাপু।
 বড়দা তাকে বোঝায়, ঠিক আছে মাথা গরম করিস না, বেলার দিকে আয় আমি দেখে নেব।
 কাঁদতে কাঁদতে পাগলী চলে গেল।
 ঘুম আমার মাথায় উঠে গেল, রয়েল বেঙ্গল টাইগারের আবির্ভাব, কোন কাজ তো করো না, পাচ্ছ খাচ্ছো আর ঘুমাচ্ছ।
 এই দেখো আমাদের আতপ চাল পাগলি চুরি করেছে, দুটো চাল ই একই রকম। আর, আম্বিয়া( কাজের মেয়ে) ওকে চালের বস্তা খুলতে দেখেছে।
 এখন তোমার কাছে নেকা কান্না কাঁদছে।টি তা তোমার তো দয়ার শরীর, বিনয়ের অবতার, এরপরও কি মাথায় তুলবে?
 বড়দার মন্ত্র একটাই, বোবার শত্রু নাই।
 সুতরাং শুনতে হল গিন্নির  অনেক কথাই, এই সংসারে এসে তার জান ঝালাপালা হয়েছে আমার জন্য।
 গজরাতে গজরাতে ঘরের বাইরে গেল।
 আম্বিয়ার সাথে পাগলীর সাপে নেউলে সম্পর্ক।
 বেলার দিকে পাগলী আর বাড়ির মধ্যে ঢুকলো না। কলতলায় আম্বিয়ার সাথে গালাগালি, তুই খানকী লাগিয়েছিস  তোর ইয়ে কে। হ্যাঁরে তর খাই না পরি, তা বলে তোরা মোকে চোর বদনাম দিলি। জানস মরে যাব তাও বি আচ্ছা, তবুও চুরি চাপাটি করার বান্দা মুই নই।
 কাঁদতে কাঁদতে আম্বিয়া বাড়িতে ঢুকলো, রয়েল বেঙ্গল টাইগার আমাকে ঠেসসা লাগালো, যাও সামলাও, আমি রাগলে কিন্তু লঙ্কা কান্ড করে দেবো।
 বড়দা নিচে এলো, এই পাগলি তোকে না আমি দেখা করতে বলেছিলাম।
 থতমত খেয়ে পাগলী বললে , না বড়দা তোমাদের বাড়িতে মুই আর কাজ করবু নি। চোর বদনাম নে কেন কাজ করব? গতর খাটালে  অন্য জায়গায় কাজ পেয়ে যাব।
 গজ গজ করতে করতে সে চলে গেল।
 সত্যি পরের দিন সে আর এলো না, ঠিক সময় দরজা খুলে দিয়েছি, কিন্তু না পাগলীর পাত্তা নেই।
 গজর গজর করতে করতে আম্বিয়া অত থালা বাসন মাজলো।
 রয়েল বেঙ্গল টাইগার চুপ হয়ে গেল।
 পরদিন সকালে মর্নিং ওয়াককে যাচ্ছে বড়দা । রাস্তা পেরোনোর সময় পাগলি সামনে দাঁড়ালো, কোথায় যাচ্ছ বড়দা?
 বড়দা বলল,মর্নিং ওয়াক। তা তোর খবর কি,কাল আসিস নি কেন?
 পাগলী বললে,তুমি বলো বরদা, চোর বদনাম নে কি কাজ করা যায়?
 বরদা তাকে বললে, মাথা ঠান্ডা কর,কাজে যা।
 ১০০ টাকার একটা নোট তার হাতে গুঁজে দিল বড়দা  ।
 পাগলি নিমরাজি হয়ে বললে, তুমি গুরুজন মানুষ বডরদা, তুমি যখন বলতিছো যাই কাজে।
 বেলার দিকে রয়েল বেঙ্গল টাইগার আমাকে বললে, তোমার পিয়ারের পাগলি আজ এসেছিল গো।
 বরদা বলল, ভালো কথা। তবে তোমার আতপ চালের কিছুটা পাগলিকে দিও। তার নাতি নাতকুলদের পিঠা পায়েস করে খাওয়াবে।
 সে বললো, আগে ও মানুক তারপর দেবো।
 আমি মিথ্যা করে বললাম, পাগলী আমার কাছে স্বীকার করেছে গো, লোভে পড়ে কিছু চাল সে নিয়েছিল।
 গিন্নি বলল,তাহলে তো ল্যাঠা চুকে গেলো।
 এই হলো পাগলী-  কাজের মেয়ে। ঠান্ডা মেজাজে যা বলবে তাই করে দেবে, এমনকি গুটা পরিষ্কার করতে বললেও করে দেবে।কিন্তু ট্যারা ভাবে বললে, তখন সে ভীষণ ট্যারা। সেইজন্যে বোধহয় সবাই তাকে  পাগলী ডাকে ।
 কিন্তু তার কোন পাগলামি আমার চোখে পড়েনি। অথচ
 জগত সংসার তাকে পাগলী বলে ডাকে!