রোববার   ২৪ নভেম্বর ২০২৪   অগ্রাহায়ণ ১০ ১৪৩১   ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শাসকের সঙ্গে সংঘাত ও বিচারালয়ের বাড়াবাড়ি

মজিবুর রহমান

পুষ্পপ্রভাত পত্রিকা

প্রকাশিত : ১১:৩৩ এএম, ২৫ জুন ২০২৪ মঙ্গলবার

শাসকের সঙ্গে সংঘাত ও বিচারালয়ের বাড়াবাড়ি
মজিবুর রহমান

     পশ্চিমবঙ্গে শাসকের সঙ্গে আদালতের সংঘাত লেগেছে। অন্তত তিন বছর ধরে এই লড়াই জোরকদমে চলছে। প্রশাসনিক হেডকোয়ার্টার নবান্ন আর কলকাতা হাইকোর্টের কাজিয়া সুপ্রিম কোর্টে গিয়ে জমা পড়ছে। দুশ্চিন্তা ও দুর্ভাবনার শিকার হচ্ছে রাজ্যের লাখ লাখ সাধারণ মানুষ। সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি হচ্ছে।সাংঘাতিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিক্ষার মতো খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি ক্ষেত্র। এই পরিস্থিতির জন্য সরকার ও আদালত উভয়েরই দায় রয়েছে। কেউই সমস্যার সমাধানে আন্তরিক নয়। বরং সমস্যাকে জটিল থেকে জটিলতর ও দীর্ঘমেয়াদি করা হয়। এখানে তিনটি বিচারবিভাগীয় নির্দেশ ও সেগুলোর অভিঘাত নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করা হল।
      বিগত কয়েক বছরে রাজ্যের সরকারি বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী নিয়োগ প্রক্রিয়ায় নানান ধরনের নিয়ম ভঙ্গের ঘটনা ঘটেছে। অজ্ঞতাবশত বা অনিচ্ছাকৃত ভুল নয় , বেশ পরিকল্পনা করে নিয়োগ প্রক্রিয়ার বিভিন্ন স্তরে বিভ্রাট ঘটানো হয়েছে। স্বজন পোষণ ও বিশাল অঙ্কের আর্থিক লেনদেন হয়েছে।পুরো ঘটনাটা একটা প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন সাংসদ, বিধায়ক, মন্ত্রী, সরকারি আধিকারিক ও শাসক দলের নেতাকর্মীরা। গত দুই বছরে ২৫-৩০ জনকে ধরা হয়েছে। ২০১৬ সালের স্কুল সার্ভিস কমিশনের প্যানেলে উত্তরপত্র তথা অপটিক্যাল মার্ক রেকগনিশন (ও এম আর) শীট বিকৃতি, সিরিয়াল ব্রেক, প্যানেলের বাইরে থেকে নিয়োগ, সুপার নিউমেরিক পোস্ট সৃষ্টি সহ বেশ কয়েক রকমের অনিয়মের সন্ধান পাওয়া গেছে। ওই প্যানেল থেকে ২৬ হাজার শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী নিযুক্ত হন। তদন্তের স্বার্থে সকলের নথিপত্রের হার্ডকপি জেলায় জেলায় ডিআই অফিসে অথবা কলকাতায় মধ্যশিক্ষা পর্ষদের অফিসে জমা করা হয়। ফোনের মাধ্যমেও তথ্য প্রদান করা হয়। সবকিছু যাচাই করে দেখা যায়, নিয়ম ভঙ্গ করে নিয়োগপত্র পাওয়া শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীর সংখ্যা আট হাজারের কম আর নিয়ম মেনে নিযুক্ত হয়েছেন আঠারো হাজারের বেশি। অর্থাৎ বৈধ শিক্ষকের সংখ্যা অবৈধ শিক্ষকের থেকে অনেকটাই বেশি। কাঁকড় বেছে ফেলার পর খাদ্য শস্য ভক্ষণ করাই সাধারণ নিয়ম। জমি থেকে আগাছা পরিষ্কার করে আমরা সবাই ফসল রক্ষা করি। আগাছার সাথে ফসল কেটে ফেলি না। কিন্তু কলকাতা উচ্চ আদালতের ডিভিশন বেঞ্চ নিয়োগ মামলার রায় দিতে গিয়ে আগাছার সাথে ফসলও কেটে ফেলার নিদান দিয়েছে।কাঁকড় না বেছে সমস্ত শস্য কণা ডাস্টবিনে ফেলার ফতোয়া জারি করেছে। ২০১৬ সালের শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীদের সব প্যানেল বাতিল। 'ঢাকি সমেত বিসর্জন'।সকলের চাকরি ক্যানসেলড। এটা কোনো বিচার হল? ন্যায়বিচারের কোনো উপাদান কি এই রায়ের মধ্যে রয়েছে? বৈধ ও অবৈধ ভাবে নিযুক্ত উভয়েরই এক পরিণতি! মুড়ি-মিছরির এক দর! ডিভিশন বেঞ্চ সাফাই দিয়েছ, বারবার বলা সত্ত্বেও নাকি নিয়োগ প্রক্রিয়ার দুই প্রধান সংস্থা স্কুল সার্ভিস কমিশন ও মধ্যশিক্ষা পর্ষদ আদালতের কাছে বৈধ ও অবৈধ কর্মপ্রার্থীদের তালিকা জমা দেয়নি।তাই আসল ও নকলকে আলাদা করা যায়নি।কিন্তু প্রশ্ন হল, কমিশন ও পর্ষদ ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করেনি বলে বৈধ চাকরিজীবীরা বরখাস্ত হয়ে যাবেন? যারা আদালতের সঙ্গে সহযোগিতা করেনি আদালত তাদের শাস্তি দিক। তাদের বাধ্য করুক প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ করতে। কমিশন ও পর্ষদের দু'চারজন আধিকারিককে বাগে আনতে না পেরে হাজার হাজার চাকরিজীবীকে ব্যতিব্যস্ত করার কোনো মানে হয়? আজকের দিনে একটা সরকারি চাকরি পাওয়া 'ভগবানের সাক্ষাৎ' পাওয়ার সমান! অথচ বৈধভাবে অর্জন করা চাকরিকে কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। ২০১৬ সালের প্যানেলে এমন অনেকেই আছেন যাঁরা ২০১১ সালের প্যানেলের চাকরি ছেড়ে এসেছেন। মাদ্রাসা সার্ভিস কমিশনের প্যানেল থেকে পাওয়া চাকরি ছেড়ে এসেছেন।অন্য কোনো পেশার চাকরি ছেড়ে এসেছেন। অর্থাৎ এঁরা একাধিকবার সফলভাবে যোগ্যতার প্রমাণ দিয়ে চাকরি করছিলেন।আদালত কোনো বাছবিচার না করে সকলকেই বাতিল করে দিল। ভেবে দেখা হল না, একটি চাকরি একটি নিম্নবিত্ত অথবা মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য কত গুরুত্বপূর্ণ! চাকরি করার সুবাদে ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নিয়ে বহুজন গাড়ি বাড়ি করেছেন। বেতন থেকে ঋণের কিস্তি মেটানো হয়। হঠাৎ বেতন বন্ধ হলে তাঁরা কিভাবে ঋণ পরিশোধ করবেন? সুদ সহ বেতন ফেরতের নির্দেশ আরও মারাত্মক।ক'জন এই নির্দেশ পালন করতে পারবেন, সন্দেহ আছে। অনেকেই ভিটেমাটি ছেড়ে পালাবেন। আত্মহননের পথ বেছে নিতে বাধ্য হবেন। একসঙ্গে এতজন শিক্ষক চাকরিচ্যুত হলে স্কুলগুলোর অবস্থা কী হবে কেউ কি ভেবে দেখেছে? এখন রাজ্যের অধিকাংশ স্কুলে শিক্ষার্থীর তুলনায় শিক্ষকের সংখ্যা অনেক কম। স্কুল ফান্ড থেকে যৎসামান্য পারিশ্রমিকের বিনিময়ে চুক্তিভিত্তিক অস্থায়ী শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী নিয়োগ করে জোড়াতালি দিয়ে চলছে। এই মুহূর্তে অনেক স্কুলে ২০১৬ সালের প্যানেলের শিক্ষকই বেশি। একসঙ্গে অর্ধেক শিক্ষক বিদায় নিলে স্কুলগুলো চলবে কী করে! নতুন নিয়োগের ব্যাপারে কোর্টের কোনো কড়া নির্দেশনা নেই, শুধু বাতিলের বেলায় বড় বড় বক্তব্য! সরকারি স্কুল ছেড়ে মেধাবী ও আর্থিক সঙ্গতি সম্পন্ন পরিবারের ছেলেমেয়েরা সব প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে চলে যাচ্ছে। শিক্ষার বেসরকারিকরণ ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যেই কি কোনো বৃহত্তর ষড়যন্ত্র চলছে?
       মুর্শিদাবাদ জেলার একটি হাইস্কুলের একজন প্রধানশিক্ষক স্কুল সার্ভিস কমিশনের সুপারিশ পত্র ও মধ্যশিক্ষা পর্ষদের নিয়োগপত্র জাল করে তাঁর ছেলেকে নিজের স্কুলেই চাকরিতে ঢোকান। কোর্টের নির্দেশে সিআইডি তদন্ত করে। অভিযুক্ত পিতা-পুত্র ও দুজন শিক্ষা আধিকারিক কারাবাস ভোগ করেন। এসব ২০২২-২৩ সালের ঘটনা।এই নিয়োগ কেলেঙ্কারির প্রেক্ষাপটে এবছর মে মাসের দ্বিতীয়ার্ধে রাজ্যের সমস্ত হাইস্কুলের সকল শিক্ষক-শিক্ষিকার নিয়োগ সংক্রান্ত তথ্য পোর্টালে আপলোড করার নির্দেশ দেওয়া হয়। হার্ডকপি ডিআই অফিসে জমা করতে বলা হয়। নথিপত্রে শিক্ষকদের সেল্ফ অ্যাটেসটেড করতে বলা হয়।এই কাজ করার জন্য স্কুলগুলো এক সপ্তাহের মতো সময় পায়। তখন রাজ্যে গরমের ছুটি ও লোকসভা নির্বাচন চলছিল।গ্ৰীষ্মাবকাশে অনেকেই চিকিৎসা করাতে অথবা ঘুরতে ভিন রাজ্যে বা বিদেশে যান।একটা পুরনো ঘটনায় দীর্ঘাবকাশের মধ্যে এমন জরুরি ভিত্তিতে নথিপত্র চাওয়ার কোনো যুক্তি থাকতে পারে না। এই ধরনের আকস্মিক নির্দেশে অফিস আদালতের স্বেচ্ছাচারী মানসিকতাই প্রকাশ পায়।পশ্চিমবঙ্গে এখন দশ হাজার হাইস্কুলে দেড় লাখ শিক্ষক আছেন। মাত্র একজন শিক্ষকের নিয়োগের ক্ষেত্রে গুরুতর জালিয়াতির অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে।কারা এর সঙ্গে জড়িত তাও জানা গেছে।আইন অনুযায়ী তাদের যত কড়া শাস্তি দেওয়া যায় দেওয়া হোক। কিন্তু একটা স্কুলের একজন শিক্ষকের অপরাধের জন্য রাজ্যের হাজার হাজার স্কুলের লক্ষাধিক শিক্ষককে তদন্তের আওতায় টেনে আনার কোনো মানে হয়? একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনার জন্য এখন সবাইকেই সন্দেহ করতে হবে? বিড়ম্বনায় ফেলতে হবে? বিশ-ত্রিশ বছর চাকরি করার পর আবার নথিপত্র দেখাতে হবে? মশা মারতে কামান দাগা হচ্ছে!
       গত ২২শে মে কলকাতা হাইকোর্টের একটি ডিভিশন বেঞ্চ ২০১০ সালের পর থেকে রাজ্য সরকারের প্রদান করা সমস্ত ওবিসি সার্টিফিকেট বাতিল বলে রায় দিয়েছে। ২০১১ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বর্তমান রাজ্য সরকারের আমলে প্রায় পাঁচ লক্ষ ওবিসি সার্টিফিকেট ইস্যু করা হয়েছে। হাইকোর্ট এগুলোকে বাতিল ঘোষণা করেছে। ইতিমধ্যে এই সার্টিফিকেট ব্যবহার করে যে সুবিধা ভোগ করা হয়েছে তার ওপর কোনো নেতিবাচক প্রভাব না পড়লেও পরবর্তীতে অনুরূপ ছাড় আর পাওয়া যাবে না। রায়ে বলা হয়েছে, ১৯৯৩ সালের অনগ্ৰসর শ্রেণী কমিশন আইন অনুযায়ী ওবিসি'র তালিকা তৈরি করতে হবে। ঘটনা হল, ১৯৯৩ সালের আইন অনুযায়ী ২০০৯ সালে কিছু জনগোষ্ঠীকে ওবিসি হিসেবে চিহ্নিত করা হয় এবং তাদের জন্য শিক্ষা ও চাকরিতে সংরক্ষণ চালু করা হয়।এই জনগোষ্ঠীর অধিকাংশই ছিল মুসলমান। ২০১২ সালে আরেকটি আইন তৈরি করে অন্যান্য অনগ্ৰসর শ্রেণীর তালিকায় আরও কিছু জনগোষ্ঠীকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।এদেরও অধিকাংশই মুসলমান। ওবিসি'র তালিকায় ধাপে ধাপে জনগোষ্ঠী সংযোজন একটি স্বাভাবিক ঘটনা।ওবিসি'র তালিকায় জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও ওবিসি'র জন্য সংরক্ষণ কিন্তু বাড়েনি। সংরক্ষণের হার বাড়েনি বলে ওবিসি'র সুবিধাভোগীদের মধ্যে শুধুমাত্র প্রতিযোগিতা তীব্রতর হয়েছে।বিষয়টি এভাবে দেখা যেতে পারে: একটি ওবিসি সংরক্ষিত পদের জন্য ২০১২ সালের আগে হয়ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগ পেত পাঁচটি জনগোষ্ঠী, এখন পায় সাতটি। এছাড়া এর আর কোনো তাৎপর্য নেই। আদালত ২০১০ সালের পরের সমস্ত ওবিসি শংসাপত্র বাতিল করলেও ২০১২ সালের যে আইনের ভিত্তিতে শংসাপত্রগুলো প্রদান করা হয়েছিল সেই আইনকে কিন্তু বাতিল করা হয়নি। ২০১২ সালের আইন যদি অসাংবিধানিক না হয় তবে সেই আইন অনুযায়ী ইস্যু করা সার্টিফিকেট কেন বাতিল হবে? ২০১২ সালের আইন যদি বেআইনি না হয় তবে ১৯৯৩ সালের আইনকে কেন ভিত্তিভূমি ধরতে হবে? একই বিষয়ে যদি একাধিক আইন থাকে তবে তো সর্বশেষ আইনকেই অগ্ৰাধিকার দেওয়ার কথা।এক খোঁচাতেই পাঁচ লাখ মানুষের সার্টিফিকেট ক্যানসেল করে দেওয়া হল। কিন্তু ভেবে দেখা হল কি ওই সার্টিফিকেট পেতে কী পরিমাণ কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে? কত সাপোর্টিং ডকুমেন্ট সংগ্ৰহ করতে হয়েছে? হঠাৎ করে এত সংখ্যক সার্টিফিকেট বাতিল হওয়ার ফলে অনেক সমস্যা দেখা দিতে পারে। চাকরিতে যে 'হান্ড্রেড পয়েন্ট রোস্টার' অনুসরণ করা হয় তাতে ওবিসি'র জন্য সতের শতাংশ সংরক্ষণ থাকে।বিগত বারো-চোদ্দো বছরের সমস্ত সার্টিফিকেট বাতিল হবার ফলে সংরক্ষিত আসনে প্রয়োজনীয় সংখ্যক কর্মপ্রার্থী পাওয়া কঠিন হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ওবিসি শিক্ষার্থীদের জন্য সংরক্ষিত আসন কোনভাবেই পূরণ হবে না। ওবিসি'দের জন্য যে ছাত্র বৃত্তি রয়েছে তাতে কেউ আবেদনকারী হতে পারবে না। তফসিলি জাতি ও তফসিলি জনজাতির সঙ্গে অন্যান্য অনগ্ৰসর শ্রেণীর আর্থ-সামাজিক পশ্চাৎপদতার দিক থেকে বিশেষ পার্থক্য নেই। ফারাক যেটুকু আছে তা ধর্মীয় পরিচয়ে। এস সি-এস টি'রা অধিকাংশই হিন্দু আর ওবিসি'রা অধিকাংশই মুসলমান।দুর্ভাগ্যবশত, স্বাধীনতার সাড়ে সাত দশক পরে ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের অঙ্গরাজ্য পশ্চিমবঙ্গে মানুষের ধর্মীয় পরিচয়কে প্রাধান্য দিয়ে ওবিসি সার্টিফিকেট বাতিল করছে বিচারালয়। বিচারের বাণী কি বৈষম্যমূলক হয়ে যাচ্ছে না? আদালত সাধারণ মানুষের ভরসার জায়গা।সেই জায়গা থেকেই বারবার ধাক্কা খেয়ে মানুষ আজ বিভ্রান্ত, বিপন্ন।