রোববার   ২৪ নভেম্বর ২০২৪   অগ্রাহায়ণ ১০ ১৪৩১   ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ভারতীয় সংবিধানের ৩০ নং ধারা ও ধর্মনিরপেক্ষ আমরা

খগেন্দ্রনাথ অধিকারী

পুষ্পপ্রভাত পত্রিকা

প্রকাশিত : ১১:১০ এএম, ২৫ জুন ২০২৪ মঙ্গলবার

ভারতীয় সংবিধানের ৩০ নং ধারা ও ধর্মনিরপেক্ষ আমরা
খগেন্দ্রনাথ অধিকারী

 আজ থেকে পৌনে একশ বছর আগে ১৯৩৩ সালের জার্মান সংসদের নির্বাচনে এদেশের নরেন্দ্র মোদীর বি. জে. পি পার্টির মত হিটলারের নাৎসী পার্টি নিরুঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলেও একক গরিষ্ঠতা পান এবং তার ভিত্তিতে, জোর জবরদস্তি করে ও ভয় ভীতি দেখিয়ে ১৯৩৫ সালে ১৫ই সেপ্টেম্বর ন্যুরেমবার্গ আইন পাশ করেন। এই আইনের উদ্দেশ্য ছিল উগ্র ইহুদি বিদ্বেষ ছড়িয়ে ইহুদিদেরকে জার্মানী থেকে নিশ্চিহ্ন করা এবং আর্য রক্তের বিশুদ্ধতার নামে উগ্র জার্মান আধিপত্যবাদ প্রতিষ্ঠা করা। ঠিক একই কায়দায় নরেন্দ্র মোদী ও তাঁর নিরঙ্কুশ সংখ্যা গরিষ্ঠতাহীন বি. জে. পি পার্টি ২০২৪ এর লোকসভা নির্বাচনের পরে উগ্র হিন্দু মৌলবাদের ধ্বজা উড়িয়ে অশোক--আকবর--দারাশিকো--বিবেকানন্দ--রবীন্দ্রনাথের দেশে বহুত্ববাদী সংস্কৃতির আদর্শকে পদদলিত করে মুসলিম--খৃশ্চান--বৌদ্ধ--জৈন নির্বিশেষে সংখ্যালঘু মানুষদেরকে নিশ্চিহ্ন করার তথা ভারতকে একটি হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করার চক্রান্তে লিপ্ত আছে। এঁদের আওয়াজ হোল হিন্দী--হিন্দু--হিন্দুস্থান। অর্থাৎ এদেশের রাষ্ট্রভাষা হবে হিন্দি, এদেশের জাতি হবে হিন্দু, এদেশের নাম হবে হিন্দুস্থান।
এই লক্ষ্যকে মাথায় রেখে দেশজুড়ে বি. জে. পি উল্লিখিত ৩০ নং ধারাকে কেন্দ্র করে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়াচ্ছে। উল্লেখ্য যে ১৯৭৬ সালে ৪২ তম সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে ভারতবর্ষকে সংবিধানের প্রস্তাবনায় একটি ধর্মনিরপেক্ষ বা "Secular" দেশ হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু এই সংবিধান সংশোধনের বহু আগে থেকেই, অর্থাৎ ১৯৫০ সালের ২৬শে জানুয়ারী সংবিধান চালুর মুহূর্ত থেকেই ভারতবর্ষ হোল একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশ। প্রকাশ থাকে যে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নে ভারতের প্রথম রাষ্ট্রদূত ছিলেন ডঃ রাধাকৃষ্ণান, যিনি ছিলেন কমরেড যোসেফ স্ট্যালিনের খুবই গুণগ্রাহী। তিনি দেখেছিলেন যে সাম্রাজ্যবাদী দুনিয়া যতই কুৎসা করুক যে কমিউনিস্টরা ধর্ম মানে না, বাস্তবে ১৯৩৬ সালের স্ট্যালিন সংবিধানে সকল মানুষের ধর্মাচরণের অধিকারকে স্বীকৃতি জানানো হয়েছিল। বিশেষ কোন ধর্মকে আলাদা ধর্ম হিসাবে স্বীকার করা হয়নি। তবে ধর্মাচরণের অধিকারের পাশাপাশি সেখানে ধর্মের বিরুদ্ধে প্রচারের অধিকারও স্বীকৃত হয়। এই সংবিধানের ১২৪ নং ধারার ভাষায় "In order to ensure to citizens freedom of conscince, the church in the u.s.s.r is separated from the state, and the school from the church. Freedom of riligious worship and freedom of antireligious propaganda is recognized for all the citizens."
আমাদের দেশের সংবিধানে ধর্মাচরণের বিরুদ্ধে প্রচারের অধিকার স্বীকৃত হয়নি। তার মূল কারণ হোল আমাদের দেশের বহুত্ববাদী সংস্কৃতির সুর হোল অধ্যাত্মবাদ, ভোগবাদ বা বস্তুতান্ত্রিকতাবাদ নয়। চার্বাকের মত ভোগবাদী দার্শনিক যার মূল কথা ছিল "যাবৎ জীবেৎ সুখম্‌ জীবেৎ, ঋনং কৃত্বা ঘৃতম পিবেৎ," -- জন্মালেও, এটা ছিল আমাদের সংস্কৃতির মূল সুরের একটি ব্যতিক্রম মাত্র: আসল সুর হোল আধ্যাত্মবাদ। এই সুরের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে আমাদের সংবিধানের মধ্যে ২৫, ২৬ ও ৩০ নং ধারায় ধর্মাচরণের অধিকার স্বীকৃত হয়েছে। প্রকাশ থাকে যে দেশ যখন সাভারকার--শ্যামাপ্রসাদের মত হিন্দু মৌলবাদীদের ও মহম্মদ আলি জিন্না--ইকবাল প্রমুখ মুসলিম মৌলবাদীদের বিষাক্ত ভাবনা ও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের চক্রান্তের ককটেলে বিভক্ত হোল, তখন হিন্দু মৌলবাদীরা দাবী তোলেন যে ভারতকে বিভক্ত করে মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্থান হয়েছে, অতএব অবশিষ্ট ভারত হবে হিন্দুস্থান। কিন্তু মহাত্মা গান্ধীসহ খণ্ডিত ভারতের শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষরা ও জাতীয় কংগ্রেস এবং ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিসহ সকল বামপন্থী ও গণতান্ত্রিক দলগুলি ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ ঐতিহ্যকে বজায় রাখার উপর জোর দেন। ফলে এই ঐতিহ্যের আদর্শকে প্রতিধ্বনিত করে আমাদের সংবিধানের উল্লিখিত ধারাগুলির মধ্যে জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সকল মানুষের ধর্মচরণের অধিকার স্বীকৃত হয়েছে। ২৫ নং ধারায় বলা হয়েছে-- " . . . all persons are equally entitled to freedom of conscience and the right freely to profess, practise, and propagate religion." ২৬ নং ধারায় বলা হয়েছে-- " . . . every religious denomination or any section therof shall have the right.
(a) to establish and maintain institutions for religious and chartable purposes;
(b) to manage its own affairs in matters of religion. 
অর্থাৎ প্রত্যেক ধর্মীয় গোষ্ঠীর লোকরা ধর্মীয় ও দাতব্যগত কারণে তাদের নিজস্ব প্রতিষ্ঠান স্থাপন ও পরিচালন করতে পারবে। এই বিষয়ে সবার সমান অধিকার। এখানে কোন বৈষম্যের অবকাশ নেই।
মনে রাখা দরকার যে একটি ধর্মীয় রাষ্ট্র যেমন সাবেক হিন্দুরাষ্ট্র নেপালে, কিংবা বর্তমান ইসলামী রাষ্ট্র ইরাণ, ইরাক কিংবা আফগানিস্থানে, বা বৌদ্ধ ধর্মীয় রাষ্ট্র মায়ানমারে, অন্য ধর্মের লোকরা নির্ম্মমভাবে নির্যাতিত হয়। হিন্দু ধর্মের পবিত্রতা রক্ষার নামে কাঠমাণ্ডুতে নেপালী রাজতন্ত্রের আমলে সংখ্যালঘুদের উপর যে বর্বরতা হয়েছে, কিংবা আফগানিস্থানে শরিয়তী শাসনের নামে তালিবান আমলে সংখ্যালঘু হিন্দু--বৌদ্ধ--খৃশ্চানদের উপর যে পাশবিকতা হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে, সেখানকার বামিয়ানে হিন্দু ও বৌদ্ধ সংস্কৃতির নিদর্শনগুলিকে যেভাবে ধূলিস্যাৎ করা হয়েছে, তা সভ্যতার লজ্জা। একইভাবে ইরাণে শিয়া মৌলবাদ ও ইরাকে সুন্নী মৌলবাদ ইসলামের নামে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের উপর যে তাণ্ডব চালিয়ে যাচ্ছে তা অকল্পনীয়। অহিংসার বাণীর প্রচারক বুদ্ধদেবের নাম ভাঙিয়ে সুচির সরকারের মদতে মানায়মারে বৌদ্ধ মৌলবাদীরা কেবল মুসলিম হবার অপরাধে রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদেরকে নারী--শিশু--যুবা--বৃদ্ধ--বৃদ্ধা নির্বিশেষে, যেভাবে রক্তের বন্যায় ভাসিয়ে দিচ্ছে, সে নৃশংসতার বর্ণনা রক্ত--মাংস--হাড়কে হিম করে। বস্তুতঃপক্ষে, এইসব কারণেই প্যালেস্টাইন মুক্তি আন্দোলনের মহানায়ক, PLO প্রধান ইয়াসের আরাফৎ বলেছিলেন তাঁর মৃত্যুর কিছু আগে, "শরিয়তের নামেই হোক, আর বাইবেলের নামেই হোক, ধর্মীয় রাষ্ট্র মানেই হোল শয়তানদের দোজোক।" আরাফতের মূল্যায়ন সর্বাংশে সত্য। কোন ধর্মীয় রাষ্ট্রে ধর্ম বা ঈশ্বরের কোন ঠাঁই নেই। সেখানে আছে বা থাকে শুধু পাশবিকতা, নৃশংসতা, অকল্পনীয় বর্বরতা। ধর্মনিরপেক্ষ তথা বহুত্ববাদী সংস্কৃতির দেশেই কেবলমাত্র সকল মানুষ মৈত্রী ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে সকল মানুষ নিজ নিজ ধর্ম ও সংস্কৃতিকে রক্ষা করে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করতে পারে।
তাই ইতিহাস প্রমাণ করে যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানবতাবাদী রাষ্ট্র নায়করা দেশের সংবিধানের মধ্যে ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধোত্তর পরিস্থিতিতে ইন্দোনেশিয়ার রাষ্ট্রপতি সুকর্ণো, ঘানার নত্রুমা, শ্রীলঙ্কার বন্দরনায়েক, কঙ্গোর লুমুম্বা, চিলির রাষ্ট্রপতি সালভাদোর আলেন্দে, আফগানিস্থানে বারবাক কারমাল ও ডঃ নজিবুল্লাহ, মিশরের রাষ্ট্রপতি আব্দেল নাসের, সবাই সংবিধানের মধ্যে ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শকে স্থান দিয়েছিলেন। উল্লেখ্য যে "Muslim Brotherhood" বলে একটি উগ্র মুসলিম মৌলবাদী সংগঠন, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী নাসেরের জাতশত্রু মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের মদতে গুলি করে আলেকজান্দ্রিয়ায় এক সভায় নাসেরকে হত্যা করার অপচেষ্টা করে। গুলিটি লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ায় অল্পের জন্য নাসের বেঁচে যান। অতি সাম্প্রতিক কালে দক্ষিণ আফ্রিকার সংবিধানে রাষ্ট্র নায়ক নেলসন ম্যাণ্ডেলা ধর্ম নিরপেক্ষতার আদর্শকে স্বীকৃতি দেন।
আমাদের দেশ ভারতবর্ষের সংবিধানের মধ্যেও উল্লিখিত ধারাগুলির মাধ্যমে ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ স্বীকৃত হয়েছে। শুধু তাই নয়। ধর্মগত, ভাষাগত, জনগোষ্ঠীগত সংখ্যালঘুরা যাতে সংখ্যাগুরুদের চাপে, আত্মবিকাশে বিঘ্নিত না হয়, তার জন্য বিশেষ সুরক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমাদের দেশের সংবিধানের ৩০ নং ধারায় বলা হয়েছে-- "All minorities, whether based on religion or language, shall have the right to establish and administer educational institutions of their choice." অর্থাৎ ধর্ম ভিত্তিক বা ভাষা ভিত্তিক সংখ্যালঘুরা তাদের অভিরুচি অনুযায়ী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন ও পরিচালনা করতে পারবে।
উগ্র হিন্দু মৌলবাদীরা এই ৩০নং ধারাটির বিকৃত ব্যাখ্যা দিয়ে বলছে যে এই ধারার অস্তিত্ব হিন্দুদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার সামিল। তারা এই ধারার অপলোপ চায়। তাদের যুক্তি যে এই ধারা বলে মুসলিম, খৃশ্চান, বৌদ্ধ, জৈন প্রমুখ সংখ্যালঘুরা তাদের পছন্দমত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন ও পরিচালনা করে তাদের ধর্মীয় শিক্ষা সেখানে দিতে পারে। কিন্তু হিন্দুদের সেই সুযোগ নেই। এই বৈষম্য কেন থাকবে? এর অবলুপ্তি দরকার। এই বিকৃত প্রচারের দ্বারা তারা সাধারণ হিন্দু--ভাই বোনদেরকে বিভ্রান্ত করছে। সংবিধানের মধ্যে পূর্বোক্ত ২৫ ও ২৬ নং ধারার তো যথাক্রমে প্রত্যেকের স্বাধীনভাবে ধর্মাচরণের অধিকার ও প্রত্যেক ধর্মীয় সম্প্রদায়ের পছন্দমত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও দাতব্য প্রতিষ্ঠান খোলার অধিকার দেওয়া আছে। কাজেই অকারণে ৩০ নং ধারা নিয়ে অপপ্রচার করে সংখ্যাগুরু হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ জনের সাথে, সংখ্যালঘু মুসলিম, খৃশ্চান প্রমুখ সম্প্রদায়ের মানুষদের এক মানসিক দূরত্ব তৈরী করা হচ্ছে। এর পরিণাম হবে ভয়ংকর। গোটা দেশটা তাসের ঘরের মত ভেঙ্গে পড়বে। এটা আমরা, এদেশের শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষরা কিছুতেই হতে দিতে পারি না। এই অপচেষ্টাকে আমরা রুখবোই রুখবো--এ আমাদের দৃঢ় অঙ্গীকার।
আসলে ইংরাজীতে "Preotective Discrimination" বা সুরক্ষা মূলক বৈষম্য বলে একটি কথা আছে। সমাজের দুর্বল অংশের মানুষদের জন্য এই পদক্ষেপ নিতে হয়। বিশ্বের বহুদেশে এর নজির আছে। ১৯৩৬ সালের সোভিয়েত সংবিধানে অর্থাৎ স্টালিন সংবিধানে কিংবা ১৯৭৭ সালের ব্রেজনেড সংবিধানে এটা ছিল, সুইজারল্যাণ্ডে বিভিন্ন ক্যান্টনে এই ব্যবস্থা আছে, নাসেরের আমলে মিশরের রাষ্ট্রবাবস্থায় খৃশ্চান, ইহুদি ও অন্যান্য সংখ্যা লঘুদের জন্য এই সুরক্ষামূলক বৈষম্যের ব্যবস্থা ছিল। যে শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদী শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করে লেনসন ম্যাণ্ডেলা দক্ষিণ আফ্রিকায় শ্বেতাঙ্গ বর্ণ বৈষম্যবাদী শাসনের অবসান ঘটিয়েছিলেন, সেই দক্ষিণ আফ্রিকায় যাতে সংখ্যালঘু শ্বেতাঙ্গরা সংখ্যাগুরু কৃষ্ণাঙ্গদের শাসনে কোন বৈষম্যের শিকার না হন, তার জন্য সংখ্যালঘু শ্বেততাকারদের সুরক্ষার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা ম্যাণ্ডেলা প্রশাসন গ্রহণ করেন। দাসত্ব প্রথা অবলোপের পর মার্কিন রাষ্ট্রপতি আব্রাহাম লিঙ্কন উদ্যোগ নিয়েছিলেন বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে বর্ণগত সংখ্যালঘুদের স্বার্থে সুরক্ষামূলক বৈষম্যবাদী পদক্ষেপ চালু করতে। কিন্তু, তার আগে তিনি খুন হন দাসপ্রভুদের চক্রান্তে। 
বিগত শতাব্দীর ত্রিশের দশকে বিশ্বব্যাপী মন্দার প্রেক্ষাপটে মার্কিন রাষ্ট্রপতি রুজভেল্ট "New Deal" কর্মসূচীর মাধ্যমে সমাজের দূর্বল অংশের মানুষকে কিছু বিশেষ সুরক্ষা দিতে চেয়েছিলেন। এর জন্য তাঁকে মার্কিন সুপ্রীমকোর্টের সঙ্গে অনেক লড়তে হয়েছিল। আমাদের দেশে ১৯৩২ সালে, আইন অমান্য আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে লণ্ডনে গোল টেবিল বৈঠকে মহাত্মা গান্ধী ভারতের জন্য পূর্ণ স্বাধীনতার দাবী তুলতে গিয়ে জিন্না ও আম্বেদকরের কাছে সমর্থন চেয়ে এ ব্যাপারে আবেদন করেন। কিন্তু জিন্না শর্ত দেন যে গান্ধীজী মুসলিমদের জন্য বিশেষ সুযোগ সুবিধার দাবী মানলে তবে তিনি এই প্রস্তাবকে সমর্থন করবেন; আম্বেদকর একই সুরে শর্ত দেন অনুন্নত জাতিগুলির জন্য বিশেষ সুবিধার দাবী গান্ধীজী মানলে তবে তাঁকে সমর্থন। জাতীয় কংগ্রেসের মধ্যে মৌলানা আবুল কালাম আজাদ থেকে শুরু করে ডঃ রাধাকৃষ্ণান কেউই এক দাবীকে মানার পক্ষে ছিলেন না। তাঁদের সবার মত ছিল জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সবার কল্যাণ। গান্ধীজীরও অভিমত ছিল তাই। তিনি বলেন "সর্বোদয়" অর্থাৎ সবার মঙ্গল সাধনই তাঁর লক্ষ্য -- কোন বিশেষ সম্প্রদায়ের নয়। ফলে গোলটেবিল বৈঠক ভেস্তে গেল।
গণপরিষদে যখন আমাদের সংবিধান রচিত হচ্ছিল, তখন এই "Preotective Discrimination"-এর প্রসঙ্গটি ওঠে। গণপরিষদের একমাত্র কমিউনিস্ট সভ্য কমরেড সোমনাথ লাহিড়ী খুব জোরের সঙ্গে ৩০ নং ধারার সংযোজনকে সংবিধানে অন্তর্ভুক্তির উপর জোর দেন সমস্ত ধর্মগত ও ভাষাগত সংখ্যালঘুদের স্বার্থে। সেই সঙ্গে শিক্ষা--চাকুরি ইত্যাদি ক্ষেত্রে সংরক্ষণের প্রশ্নে আম্বেদকর নির্দেশিত জাতপাত ভিত্তিক ব্যবস্থা (Caste based reservation) র পরিবর্তে অর্থনৈতিক ভিত্তিক সংরক্ষণের কথা বলেন। তাঁর এই দ্বিতীয় প্রস্তাব গৃহীত হয়নি। দেশের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষরা জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে অর্থনৈতিক ভিত্তিক সংরক্ষণের জন্য লড়ছেন। সে লড়াই যে অচিরেই জয়যুক্ত হবে, এ আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস। আর উল্লিখিত ৩০ নং ধারাকে সংবিধান থেকে খারিজ করে দিয়ে আমাদের দেশের ধর্ম-নিরপেক্ষতার ঐতিহ্যকে বিপন্ন করার যে ধূর্ত গৈরিকী অপপ্রয়াস, তাকে ব্যর্থ করে দিয়ে অশোক--আকবর--দারাশিকো--বিবেকানন্দ--রবীন্দ্রনাথের-নজরুলের উত্তরসূরীরা যে আমাদের দেশের বহুত্ববাদী পরম্পরাকে রক্ষা করবেনই করবেন, সে বিষয়ে আমরা নিযুত নিশ্চয়। 

      

লেখক পরিচিতি
অধ্যাপক খগেন্দ্রনাথ অধিকারী রাষ্ট্রীয় বিদ্যাসরস্বতী পুরস্কার ও এশিয়া প্যাসিফিক পুরস্কার সহ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বহু পুরস্কার প্রাপ্ত একজন খ্যাতনামা শিক্ষাবিদ। ইনি কোলকাতার সাউথ সিটি (দিবা) কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ।
ঠিকানা-শরনিয়ার বাগান
পোষ্ট-টাকী, পিন-৭৪৩৪২৯
পশ্চিমবঙ্গ, ভারত