মঙ্গলবার   ২৬ নভেম্বর ২০২৪   অগ্রাহায়ণ ১১ ১৪৩১   ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

গল্প - জ্যোতি

খগেন্দ্রনাথ অধিকারী

পুষ্পপ্রভাত পত্রিকা

প্রকাশিত : ১১:১৪ এএম, ২০ জুন ২০২৪ বৃহস্পতিবার

জ্যোতি
খগেন্দ্রনাথ অধিকারী

স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির মিটিং সেরে অবসরপ্রাপ্ত সত্তরোর্দ্ধ শিক্ষক, নৃপেন বাবু,  ডঃ নৃপেন্দ্রনাথ রায়, বারাসাত স্টেশানে ২ নং প্লাটফর্ম থেকে ৫ নং প্লাটফর্মে যাবার জন্য ওভার ব্রিজের সিঁড়ি ভাঙছেন অতি ধীরে ধীরে বাঁহাতে সিঁড়ির রেলিং ধরে ধরে। তাঁকে দেখে কালো কুচকুচে হিজাব পরা কুড়ি বাইশ বছরের একটি তরুণী তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস কোরলো-- Uncle! কষ্ট হচ্ছে আপনার? আমার হাত ধরুন। আমি আপনাকে উপরে নিয়ে যাচ্ছি।
--না না মা! কোন অসুবিধা হচ্ছে না আমার। তাড়াহুড়ো না করে, এমনিই ধীরে সুস্থে একপাশ দিয়ে উঠছি মা।
--ঠিক আছে কাকু! সাবধানে আসুন। আমি তাহলে যাই?
--হ্যাঁ মা এসো এসো। ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করুন।
মেয়েটি তরতর করে উঠে চলে গেল। ডঃ রায় যেন মন্ত্র মুগ্ধের মত চুপ হয়ে গেলেন। অস্ফুটে নিজের মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো--এ কি মানবী না দেবী!
সর্বাঙ্গ কালো পোশাকে ঢাকা থাকায় তন্বীর গায়ের রং বোঝার উপায় ছিল না। কিন্তু সিঁদূর রাঙা নাক আর পদ্মের কলির মত হাতের আঙ্গুলগুলো দেখে তাঁর মনে হোল এ নিশ্চয়ই হঠাৎ আকাশ থেকে নেমে আসা বেহেস্তের কোন পরী, স্বর্গের কোন দেবকন্যা। গলার ওইটুকু কণ্ঠস্বরে ঝরে পড়েছে যেন অমৃতের সহস্র ধারা।
আস্তে আস্তে ওভার ব্রিজের উপরে উঠে একপাশে সরে গিয়ে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে ভাবতে থাকেন আজকের ম্যানেজিং কমিটির সভায় ছাত্রীদের ড্রেস কোড নিয়ে তিক্ত বিতর্কের কথা আর এই কিশোরীর মধুর ব্যবহারের কথা। হিজাব অর নো হিজাব নিয়ে স্কুলের সভা ছিল আজ সরগরম। প্রায় ৩৫ বছরের কাছাকাছি মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরে তিনি পড়িয়ে এসেছেন। কত সরকার এসেছে গেছে, তিনি ছাত্রজীবন থেকে, পরবর্তীকালে কর্মজীবনে তিনি দেখেছেন। কিন্তু এসব জিনিষ তিনি দেখেননি। ছেলে মেয়েদের খাওয়াই জুটতো না, কোন মতে তারা লজ্জা নিবারণ কোরতো! আর ড্রেস কোড! ওসব ভাববারই কোন অবকাশ ছিল না তখন অধিকাংশ মানুষের, অধিকাংশ স্কুলের।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের মনেই তিনি বলেন, এখনো সেই অবস্থাই আছে; বরং অবস্থা এখন আরো খারাপ। গোটা সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থাটা পচে গেছে। কি রাজ্য সরকার, কি কেন্দ্রীয় সরকার, দুটোই জন্তু জানোয়ারদের জন্য উৎসর্গীত সরকার। মানুষের দারিদ্র্য, বেকারী, ক্ষুধা, এসবের মোচনে কোন লক্ষ্যই কোন সরকারের নেই। শুধু আকণ্ঠ ধাপ্পাবাজি, ও গুণ্ডাবাজি ও দুর্নীতিবাজি দিয়ে রাজ্য ও দেশ চলছে। কেবল "ডোল দেওয়ার" প্রতিযোগীতা চলছে রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের মধ্যে। লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, অমুক ভাণ্ডার, তমুক ভাণ্ডার করে আসলে মালক্ষ্মীকে বাংলা ছাড়া ও ভারতছাড়া করা হচ্ছে। বাঙালী সহ গোটা ভারতবাসীকে একটি ভিক্ষাগ্রহণকারী জনতায় পরিণত করছে। আমাদের ঘরের ছেলে মেয়েদের কর্মসংস্থানের কি হবে, সে সব বিষয় "ভাণ্ডার" নামক সর্ব্বনাশা আফিঙের গুলি খাইয়ে দিয়ে মানুষকে দিকভোলা করে দেওয়া হচ্ছে।
স্বগত উক্তি করে ডঃ রায় বলে ওঠেন
--এর ওপর রয়েছে ধর্মান্ধদের অসভ্যতা। কেউ রামের নামে, কেউ রহিমের নামে, সর্বত্র মানুষে মানুষে বিচ্ছেদ ঘটাচ্ছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে যা মানুষ তৈরীর প্রতিষ্ঠান, সেখানে সরস্বতী বন্দনার নামে, হিজাব নো হিজাব নিয়ে ড্রেসকোডের নামে পরিবেশ বিষাক্ত হচ্ছে।
--না না, এসব মানা যায় না। অসহনীয় এসব। আজ তো কমিটির মিটিঙে আলোচনা অসমাপ্ত রইলো। পরের মিটিঙে আমি জোরের সঙ্গেই বোলবো, যার যেমন জুটবে, সে তেমন পোষাক পরে আসবে। ওই তো হিজাব পরা ওই মামনিটি! কি অপূর্ব! কি সুন্দর তার ব্যবহার। পোষাকে কি আসে যায়?
ওভার ব্রীজের ওপর থেকে দেখা যাচ্ছে, নীচে একটু দূরে রেল লাইনের পাশে কৃষ্ণচূড়া গাছ গুলো দাঁড়িয়ে আছে। তাদের কাণ্ডগুলোর গায়ের রং তো সুন্দর নয়। কিন্তু তাদের শাখাগুলো কেমন ভরে আছে রাঙা রাঙা কলিতে, অস্তগামী সূর্যের শেষ রক্তরাগে কি অপূর্ব জ্যোতি বেরিয়ে আসছে তাদের থেকে। ওটাই তো ফুলের আসল, মানুষের বেলাতেও ঠিক তাই।
ধীরে ধীরে এবার রেলিং ধরে সিঁড়ি বেয়ে পাঁচ নম্বর প্লাটফর্মে নামতে থাকেন বৃদ্ধ শিক্ষক। তিনি স্পষ্ট লক্ষ্য করেন ও শোনেন, আজ দশহারা, কাল ইদুজ্জোহা। তাই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির আহ্বান জানিয়ে বারাসাত স্টেশানের শতাধিক হকার তাদের ব্যানার নিয়ে মিছিল করছে, আর কিছু তরুণ তরুণী তাদের সঙ্গে গাইছে অতুল প্রসাদী গান--
"নানা ভাষা, নানা মত, নানা পরিধান,
বিবিধের মাঝে দেখ মিলন মহান।"
খুশীতে ভরে ওঠেন তিনি। কেউ শুনুক না শুনুক, তিনি বলে ওঠেন, এরাই, এই তথাকথিত অর্ধ্-শিক্ষিত, অশিক্ষিত, আধপেটা মানুষগুলো, এরাই দেশকে বাঁচাবে, রাজ্যকে বাঁচাবে, ভাণ্ডার--হিজাব কিংবা বন্দনার হিসাব নিকাষ সব চুকাবে এরা, ঠিক এরাই।

     
লেখক পরিচিতি
অধ্যাপক খগেন্দ্রনাথ অধিকারী রাষ্ট্রীয় বিদ্যাসরস্বতী পুরস্কার ও এশিয়া প্যাসিফিক পুরস্কার সহ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বহু পুরস্কার প্রাপ্ত একজন খ্যাতনামা শিক্ষাবিদ। ইনি কোলকাতার সাউথ সিটি (দিবা) কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ।
ঠিকানা-শরনিয়ার বাগান
পোষ্ট-টাকী, পিন-৭৪৩৪২৯
পশ্চিমবঙ্গ, ভারত