বৃহস্পতিবার   ১৪ নভেম্বর ২০২৪   কার্তিক ৩০ ১৪৩১   ১২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

Meditation" নয়, "Media-Attention": মানুষের চোখ খুলেছে

খগেন্দ্রনাথ অধিকারী

পুষ্পপ্রভাত পত্রিকা

প্রকাশিত : ০৪:৫৯ পিএম, ২ জুন ২০২৪ রোববার

"Meditation" নয়, "Media-Attention": মানুষের চোখ খুলেছে
খগেন্দ্রনাথ অধিকারী

ধ্যান আর ধ্যানাচি এক নয়: একইভাবে "Meditation" আর "Media-Attention" ও এক নয়। হিটলার আর্যরক্তের পবিত্রতার দোহাই পেড়ে অগণিত ইহুদির রক্তে হাত রাঙিয়ে, নিজের পক্ষে অ-ইহুদিদের ভাবাবেগকে কাজে লাগাতে, চরম ব্যভিচারী জীবন যাত্রা তার রক্ষিতা ইভা ব্রাউনের সঙ্গে অব্যাহত রেখে হঠাৎ খুব ঈশ্বরভক্তি তথা ধর্মকর্ম করার ভান করেন। কিন্তু তাতে তাঁর, তাঁর রক্ষিতা ইভার, কিংবা গোটা নাৎসীদের রেহাই হয়নি। সোভিয়েত লাল ফৌজের হাতে তাদের বিনাশ ঘটেছে, ভূগর্ভস্থ বাঙ্কারে হিটলার--ইভাকে যথাক্রমে পিস্তলের গুলি ও সায়নায়েড ক্যাপসুলে আত্মহত্যা করতে হয়েছে। উগ্র মুসলিম বিদ্বেষে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু ও তাঁর মদতদাতা মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন হাজার হাজার নিরপরাধ প্যালেস্টাইনবাসীকে খুন করে ইহুদি ভাবাবেগকে কাজে লাগাতে এখন "জিহোভা"র দোহাই পাড়ছে। কিন্তু তাতে কোন লাভ হচ্ছে না। খোদ ইসরায়েলে রাজধানী শহর জেরুশালেমে ও প্রধান বাণিজ্য শহর তেল আভিভে জেরুজালেমে ও প্রধান বাণিজ্য শহর তেল আভিভে ইহুদিরা প্যালেস্টাইনকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে মেনে নেবার দাবী তুলে রাজপথে নেমেছে। একইভাবে মার্কিন জণগন জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সে দেশের বড় বড় শহরগুলিতে উত্তাল বিক্ষোভে সরব হয়ে উঠেছেন। অর্থাৎ, মানুষের খুনে হাত রাঙিয়ে এখন ঈশ্বর ভক্তির ভেক ধরে শতচেষ্টা করেও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও তার তাঁবেদার ইসরায়েল এখন হালে পানি পাচ্ছে না।
মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের আর তার উচ্ছিষ্টভোগী তথা ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর দোসর, আমাদের দেশের বি. জে. পি সরকারের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী উগ্র হিন্দুত্ববাদী তথা মুসলিম ও খৃশ্চান বিদ্বেষবাদী দৃষ্টি কোণে অশোক--আকবর--দারাশিকো--বিবেকানন্দ--রবীন্দ্রনাথ--নজরুলের মাটিকে, গঙ্গা--যমুনা--গোদাবরী--সবরমতির তরঙ্গ বিধৌত ভূমিকে রক্ত সিক্ত করেছেন, দেশের ঐক্য, সংহতি ও ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানকে বিপন্ন করেছেন ও করছেন, সর্ব্বোপরি এই লোকসভা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিভাজনের রাজনীতির বিষবাষ্প ছড়িয়ে গোটা দেশে বিষাক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করেছেন।
১লা জুন হয়েছে শেষ দফার ভোট। ৩০শে মে বিকেলে হয়েছে শেষ দফার ভোটের প্রচার শেষ। তার আগেই এই ৩০ তারিখে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী গেরুয়া বসন পরে বসেছেন কন্যাকুমারিকায় বিবেকানন্দ রকে তথাকথিত ধ্যানে অর্থাৎ Meditation-এ। আসলে এটাও ১লা জুন ভোট শেষ হবার আগের মুহুর্ত পর্যন্ত হিন্দু ভাবাবেগকে উস্কে ভোট দাতাদেরকে Media-Attention মারফৎ অর্থাৎ গণপ্রচার মাধ্যম মারফৎ প্রভাবিত করার এক সুচতুর কৌশল। শুধু তাই নয়। লক্ষণীয় যে ১লা জুন শেষ দফায় পশ্চিমবঙ্গের প্রায় এক চতুর্থাংশ অর্থাৎ নয়টি আসনে ভোট হবে। এই রাজ্যেরই মানুষ ছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ। সুতরাং একইসঙ্গে হিন্দুভাবাবেগ ও বাঙালী ভাবাবেগকে উস্কে এই আসনগুলির ভোট দাতাদেরকে পদ্ম শিবিরের দিকে প্রভাবিত করার লক্ষ্যে কন্যাকুমারিকার বিবেকানন্দ রককে ধ্যানের জায়গা হিসাবে বাছাই করা হয়েছে।
কিন্তু, পশ্চিমবাংলার মানুষ তথা সারা ভারতবর্ষের মানুষ অতো মূর্খ নন। তথাকথিত ধ্যানের নামে ধ্যানাচির চালাকি খুব ভালো তাঁরা বোঝেন। তাই বিগত লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল থেকে বোঝা যায় যে ভারতের সিংহভাগ মানুষ হিন্দু ধর্মাবলম্বী হলেও, বি. জে. পি চল্লিশ শতাংশের চেয়েও অনেক অনেক কম ভোট পেয়েও সরকারে গেছে আমাদের দেশের বহুদলীয় সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার কারণে। কি বাঙালী, কি অবাঙালী নির্বিশেষে এই দেশের শুভবুদ্ধি সম্পন্ন হিন্দুরা আর যাই হোক মানবী মাতার সন্তান: তাঁরা জয় সিয়ারামের চেলাচেলীদের মত "গো মাতার" সন্তান নন। তাই তাঁরা স্বামী বিবেকানন্দের জীবনের ইতিহাসটা জানেন। তাঁরা জানেন যে স্বামীজী ভারতমাতার সন্ধানে বেরিয়ে কাশ্মীরে ঝিলাম নদীর এক মুসলিম মাঝির কিশোরী কন্যাকে মাতৃজ্ঞানে পূজো করেছিলেন এবং সেখান থেকেই শারদীয়া মহাষ্টমী তিথিতে হয়েছিল কুমারী পূজার চল। সুতরাং স্বামী বিবেকানন্দের মূর্তির সামনে বিবেকানন্দ রকে বসে গেরুয়া বসন পরে ধ্যানের ধ্যানাচী করে না বাঙালী হিন্দু, না অবাঙালী হিন্দু, কোন ধর্মনিরপেক্ষ হিন্দুকে প্রভাবিত করা যাবে না। এই ধরনের শুভবুদ্ধি সম্পন্ন হিন্দুদের সংখ্যাই এদেশে বেশী এবং তাঁরা মুসলিম--খৃশ্চান--বৌদ্ধ--জৈন সবার সঙ্গে মৈত্রীর আবেশে বসবাস করতে চান এবং বসবাস করে আসছেন। শুধুমাত্র অ বি. জে. পি ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলির মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়ার অভাবেই বিগত নির্বাচনগুলিতে কেন্দ্র ও বিভিন্ন রাজ্যে বি. জে. পি ক্ষমতায় এসেছে ৩৫%-৪০% এর মধ্যে ভোট পেয়ে: কোথাও কোথাও তার চেয়েও কম ভোট পেয়ে।
এবারের পরিস্থিতি অনেকটাই অন্য রকমের। বাম ও গণতান্ত্রিক দলগুলি নূন্যতম কর্মসূচীর ভিত্তিতে ইন্ডিয়া জোট তৈরী করেছেন ফলে অ-বি. জে. পি ভোটের বিভাজন কম হবে। তাই নরেন্দ্র মোদীদের ক্ষমতাচ্যূত হবার সম্ভাবনা প্রবল। সে কারণ Meditation -এর নামে "Media-Attention" "Draw" করে শেষ পর্বের ভোট দাতাদেরকেও প্রভাবিত করার জন্য এই ছলনার আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। মনে রাখতে হবে যে বিশ্বের যে কোন ধনবাদী দেশগুলির মত আমাদের দেশেও "Media" অর্থাৎ গণমাধ্যমগুলি, যথা বেতার, দূরদর্শন, সংবাদপত্র ইত্যাদি সবগুলিই বড় বড় ধনীক গোষ্ঠীর হাতে। মোদী সরকার তো তাদেরই সেবা দাস। তারা তাদের স্বার্থেই চায় বি. জে. পি ক্ষমতায় ফিরে আসুক। তাই ধর্মীয় ভাবাবেগ সৃষ্টিকারী ফটো, অর্থাৎ নরেন্দ্র মোদীর গেরুয়া বসন পরা ধ্যান মগ্ন ছবি প্রচার করে হিন্দু ভোট দাতাদের মন জয় করার কাজে গণমাধ্যমগুলি কোমর বেঁধে লেগেছে।
কিন্তু এরা মূর্খ। এরা ইতিহাসের শিক্ষাটা জানে না। নরেন্দ্র মোদীদের ভাবগুরু হিটলারের প্রচার সচিব গোয়েবেলস্‌ ছিলেন ভাণ্ডামি ও মিথ্যাচারের "সিদ্ধ (কু) পুরুষ"। তিনি বলতেন একটা মিথ্যা কথা একশবার বললে, কিংবা একটা ভণ্ডামি একশবার করলে, একশ একবারের বার মানুষ সেটাকে সত্য বলে মনে করবে। কিন্তু সেই কুখ্যাত গোয়েবলস্‌ ও বাঁচেননি, বাঁচাতে পারেননি তাঁর মহানায়ক হিটলারকে। একইভাবে আমাদের দেশের বৃহৎ ধনী পরিবারগুলির নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যমগুলিও পারবে না মোদী রাজকে অর্থাৎ বি. জে. পি শাসনকে বাঁচাতে ঐ ধ্যানের ধ্যানাচি করা ছবি দেখিয়ে।
মোট কথা, সামাজিক বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার গবেষণালব্ধ ফলের ভিত্তিতে একথা বলা যায় যে মানুষের আর্থ--সামাজিক--রাজনৈতিক আচরণের উপর "Media-Attention" বা গণমাধ্যমের প্রচারের একটা প্রভাব আছে। প্রভাব আছে বলেই তো গোয়েবলস্‌ এর মত শয়তান প্রচার সচিবের দৌলতে হিটলার এতখানি অক্সিজেন পেয়েছিলেন। না হলে বহু আগেই তাঁর পতন হোত। কিন্তু এটাও এর থেকে পরিষ্কার যে মিথ্যা প্রচার বা ভনিতা সাময়িকভাবে মানুষকে গণমাধ্যমের দ্বারা বিভ্রান্ত করতে পারে, কিন্তু বেশীদিন পারে না। সত্য প্রকাশ হয়ই হয় এবং তখন মানুষ ঐ অপপ্রচারকারীদের চরম দণ্ড দেয়, যেমন ঘটেছিল নাৎসী ও ফ্যাসিস্টদের কপালে। আমাদের দেশেও নরেন্দ্র মোদী ও তার চেলাদের কপালে ঐ একই জিনিষ ঘটবে--ভণ্ডামী ও ধাপ্পাবাজির মুখোষ খুলতে আর দেরী নেই, যেমন দেরী হয়নি জো-বাইডেন ও বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুদের মুখোশ খুলতে। সব ধাপ্পাবাজি ও ভণ্ডামি বুঝতে পেরে উত্তর গোলার্ধের আয়ারল্যাণ্ডসহ একাধিক দেশ প্যালেস্টাইনকে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং আরও অনেক দেশ সেই পথে এগুচ্ছে।
তাই বলি, আমাদের দেশের ধর্মনিরপেক্ষ শুভবুদ্ধি সম্পন্ন "Public" আমাদের এই গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ সার্ব্বভৌম "Republic" কে জয় সীয়ারামদের রাক্ষসকূলের হাত থেকে রক্ষা করবে, আবার দিকে দিকে ভেসে উঠবে, নজরুলের সেই হৃদয় জুড়ানো গান--
"মোরা একই বৃন্তে দু'টি কুসুম হিন্দু মুসলমান,
মুসলিম তার নয়ন মণি,
হিন্দু তাহার প্রাণ।"
(লেখকের নিজস্ব মতামত)

      
লেখক পরিচিতি
অধ্যাপক খগেন্দ্রনাথ অধিকারী রাষ্ট্রীয় বিদ্যাসরস্বতী পুরস্কার ও এশিয়া প্যাসিফিক পুরস্কার সহ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বহু পুরস্কার প্রাপ্ত একজন খ্যাতনামা শিক্ষাবিদ। ইনি কোলকাতার সাউথ সিটি (দিবা) কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ।
ঠিকানা-শরনিয়ার বাগান
পোষ্ট-টাকী, পিন-৭৪৩৪২৯
পশ্চিমবঙ্গ, ভারত