গল্প - ঝিলাম রাজের কথা
খগেন্দ্রনাথ অধিকারী (প্রাক্তন অধ্যক্ষ)
পুষ্পপ্রভাত পত্রিকা
প্রকাশিত : ০৯:০৪ এএম, ১০ মে ২০২৪ শুক্রবার
ঝিলাম রাজের কথা
খগেন্দ্রনাথ অধিকারী (প্রাক্তন অধ্যক্ষ)
দু'দলের ফুটবল ম্যাচ শেষ। মিতালী সংঘ জিতেছে ২-১ গোলে ভ্রাতৃসংঘকে হারিয়ে। খেলার শেষে বিজয়ীদের তাঁবুতে গিয়ে বিজিতরা শুভেচ্ছা জানিয়ে আসছে। কিন্তু গোলকিপার মনোজ গেলো না। সে চুপ চাপ ভ্রাতৃসংঘের তাঁবুর এককোণে বসে আছে। ওদের দলের এক খেলোয়াড় ইমরান ওকে ডেকে বলল--
এই ভাই চল। সবাই যাচ্ছে ওদেরকে কনগ্রাচুলেট করতে; তুই না গেলে ভাববে হিংসেয় বা পরাজয়ের জ্বালায় তুই যাচ্ছিস নে। একটা ভুল বার্তা যাবে তোর সম্পর্কে।
--দ্যাখ ভাই ইম্যু! তুই যে কথাটা বলেছিস, সেটা উড়িয়ে দেবার নয় একেবারে। তবে কথা কি জানিস ভাই, ছোটবেলা থেকে আমি একটা মূল্যবোধ নিয়ে বড় হয়ে উঠেছি; তার সঙ্গে আপোষ করতে পারবো না। তাই Sorry ভাই। আমি যাবো না।
--কিসের আপোষ মনোজ?
--তাহলে ভাই বলি শোন। আমি গরীব ঘরের ছেলে। ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ার সুযোগ পাইনি। গ্রামের পাঠশালায় পড়েছি। আব্দুল ছাত্তার ওস্তাদজী বলে এক হত দরিদ্র শীর্ণকায় দীর্ঘদেহী বৃদ্ধ শিক্ষক আমাদের গল্পচ্ছলে ক্লাশ থ্রিতে ইতিহাস পড়াতেন। বছর কয়েক আগে অপুষ্টিতে তিনি মারা গেছেন। কিন্তু তাঁর সেই পড়ানোটা আজও আমার অন্তরে গেঁথে আছে। তাই ভাই আমি যাবো না।
--স্যারের কি পড়ানো, আমায় একটু বল ভাই।
--তখনকার স্যারেরা ছিলেন খুব ill-Paid! কিন্তু তাঁদের পড়ানো ছিল অনবদ্য। স্যার পড়িয়ে ছিলেন বন্দী পুরুর সঙ্গে বিজয়ী আলেকজাণ্ডারের কথোপকথন। ওঃ, মনে হচ্ছিল স্যারই যেন গ্রীকবীরের দরবারে শৃঙ্খলিত ঝিলাম রাজ! স্যার শুরু করেছিলেন এইভাবে--
হে রাজবন্দী! আপনি আমার কাছে কিরূপ ব্যবহার আশা করেন?
--একজন বীর আর একজন বীরের কাছে যা আশা করে ঠিক তাই রাজন।
--তার মানে?
--তার মানে, আমার দেশের ভীরু--কাপুরুষ--তক্ষশীলার রাজা অম্ভির মত ক্রীতদাসের অধীনতা আশা করি না--আমি চাই সম্মান জনক মিত্রতা আপনার সাথে। আমি মহারাজ পরাজিত, আমি যুদ্ধে হেরেছি আপনার কাছে, কিন্তু হারিয়ে যাইনি। আমি আজও উন্নত শির বীর পুরু।
--বন্দী বীর! অম্ভিত তো মিত্রতা করেছেন আমার সাথে।
--হে দিগ্বীজয়ী। আমার ধৃষ্টতা মার্জনা করবেন। মিত্রতা হয় দুই ভাবে--(১) কাপুরুষরা বিজেতার গুহ্যদ্বার দিয়ে তাঁর শরীরে প্রবেশ করে এবং সেখানে মলমূত্র খেয়ে পুষ্ট হয়। আর আত্মমর্যাদাবানরা বন্ধুত্বের স্থান চান বিজেতার বুকে--বাহুবন্ধনে আবিষ্ঠ হয়ে তাঁর অন্তরে। আমি এই দ্বিতীয়টিই চাই হে ম্যাসিডোনিয়া অধিপতি।
সেনাপতি সেলুকাস সহ সবাই হতবাক। বিস্মিত সম্রাট আলেকজাণ্ডার। আপন আসন ছেড়ে উঠে তিনি পায়ে পায়ে পুরুর দিকে এগিয়ে গেলেন; নিজের হাতে তাঁকে শৃঙ্খলমুক্ত করে বুকে জড়িয়ে ধরলেন সাদরে।
একটু থেমে মনোজ বললো--স্যারের এই বর্ণনা সব সময় আমাকে উদ্দীপ্ত করে। আমি আত্মদম্ভী নই ইমরান, আমি হিংসুটেও নই। আমি আত্ম মর্যাদা বোধ সম্পন্ন। খেলায় হেরে গেছি; হার মেনে নিয়েছি। তাই বলে আর পাঁচটা মেরুদণ্ডহীন খ্যালেণ্ডার মত খেজুরে আলাপ জমাতে আমি বিজেতাদের তাঁবুতে কখনোই যেতে পারবো না। যাবো না। বরং চেষ্টা করবো যাতে ভবিষ্যতে আমাদের Team জয়ের মুখ দেখে সেই প্রয়াস চালাতে।
শীতকালের বেলা। সূর্য্য ডুবু ডুবু। ইমরান দেখলো, অস্তগামীর শেষ রক্তরাগে তার খেলোয়াড় বন্ধুর মুখখানি প্রত্যয়ে লালে লাল হয়ে উঠেছে।
লেখক পরিচিতি:
অধ্যাপক খগেন্দ্রনাথ অধিকারী রাষ্ট্রীয় বিদ্যাসরস্বতী পুরস্কার ও এশিয়া প্যাসিফিক পুরস্কার সহ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বহু পুরস্কার প্রাপ্ত একজন খ্যাতনামা শিক্ষাবিদ। ইনি কোলকাতার সাউথ সিটি (দিবা) কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ।
ঠিকানা-শরনিয়ার বাগান
পোষ্ট-টাকী, পিন-৭৪৩৪২৯
পশ্চিমবঙ্গ, ভারত