ষষ্টি জল অভ্র মহান্ত
পুষ্পপ্রভাত পত্রিকা
প্রকাশিত : ০৬:১২ এএম, ২ অক্টোবর ২০২৩ সোমবার
ষষ্টি জল
- অভ্র মহান্ত
পুজো শুরু হতে আর দুই দিন বাকি । আশু এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওদের বাগানের কলাগাছের চাউনিটার দিকে । ও প্রায়েই ওইদিকে তাকিয়ে , কি যে ভাবে তা উদ্ধার করার স্বয়ং ভগবানেরো সাদ্ধ নেই । এর জন্য পাড়ায় অনেকেই ওকে ভব গোপাল বলে ডাকে । অশুর একটা বোন আছে নাম রানী , ক্লাস টু তে পরে । ওর মা , বীণাপানি , ওর মায়ের নামের সাথেই মিল কোরে ওর বোনের নাম দেওয়া হয়েছে । অশুরা খুব গরিব । ওর বাবার চৌরঙ্গী স্ট্রিটে একটা ছোট্ট জামাকাপড়ের দোকান আছে । আর ওর মা লোকের বাড়িতে বাড়িতে কাজ করে । ওখান থেকেই যা টাকা আসে সে দিয়ে ওদের কোনোক্রমে সংসার চলে । ওর বাবার চারিদিকে ধার । ভেবেছে পুজোয় বিক্রি কোরে যা উপার্জন হবে সে দিয়েই অল্প কিছু ধার মেটাবে ।
আশু ! আশু ! শুনে যা বাবা ডাকছে । আশু বিছানা থেকে নেমে পাশের ঘরে গেলো । আশু তাড়াতাড়ি তৈরী হয়েনে , পুজো তো এসেই গেলো , একটু হাট থেকে ঘুরে আসি । দেখি অল্প কিছু জামাকাপড় যদি নিয়ে আসতে পারি । অশুর তৈরী হতে বেশিক্ষন লাগে না যা সময় লাগে ওর বোনের । ও এই প্রথমবার বাবার সাথে হাটে যাচ্ছে , মানে আজ ওর প্রথম হাট দেখা । প্রতিবার আজকের মতো অশুর জায়গায় ওর মাই যায় । ওর মায়ের মাথার ব্যথাটা বেড়েছে বলে ও যাচ্ছে । ওদের বাড়ি থেকে হাট প্রায় এক ঘন্টার পথ । দুই বার বাস পাল্টাতে হয় ।
হাটে পৌঁছে আশু দেখে , সে এক তাজ্জব দৃশ্য । চারি পাশে সারী সারী দোকান আর দলে দলে লোক । নানা রকম রংএর জামাকাপড়ে যেন দোকান গুলো ঠাসা । দলে দলে লোক বললে খুব ভুল বলা হবে , যেন মানুষের বন্যা বয়ে চলেছে । যেন মনে হচ্ছে পৃথিবীর সব মানুষ এক জায়গায় জোট বেঁধেছে । নানান লোকের নানান গল্প কানে আসছে অশুর । কোথা থেকে যেন একটা হিন্দি ছবির গান ভেসে আসছে । প্রথম তিনটে দোকান পেরিয়ে পরের দোকানটায় অশুরা ঢুকলো । এখানকার সব দোকান গুলোই যেন একটা মাঝারি ঘর কে দুই ভাগ কোরে , তার এক ভাগ কে যেইরম দেখতে লাগে সেইরম বলা যেতে পারে । দোকানের মাথায় বোর্ডে স্পষ্ট কোরে লেখা " শ্যামল জি . আর স্টোর " । জি . আরের অর্থ ইংরেজি শব্দে " গার্মেন্ট " । দোকানের সামনে একটা পঞ্চাশ বছরের পুরোনো লোহার জন্গ্ধরা টেবিল পাতা , সেখানেই গিয়ে আশু বসলো । আর ওর বাবা গেলো ভিতরে কোথা বলতে । আশু যেইখানে বসে আছে , সেইখান থেকে ঠিক দশ বারো হাত দূরে দুই লোকে ঝগড়া বেঁধেছে । আর ঝগড়া দেখতে তো সবারই ভালো লাগে , তাই অশুই বা বাদ যাবে কেনো । কিন্তু ঝগড়াটা কি নিয়ে তা অবশ্য জানা যায়নি । ঠিক আধঘন্টা পর অশুর বাবা দুহাতে দুগোছা জামা নিয়ে বেরিয়ে এলো । অশুরা আবার হাঁটা দিলো সামনের দিকে । রাস্তার ধরে ধরে প্রায় বাসের মতো কত বড়ো বড়ো গাড়ি । ঐ গুলো বোধয় বড়ো বড়ো শপিং মলের গাড়ি । অশুরা হেঁটেই চলেছে কখনো ওই দকান কখনো সেই দোকান । অনেক্ষন হাঁটার পর আশু দেখে এক জায়গায় একটা দোকানের সামনে অনেক লোক জমা হয়েছে । আশু প্রথমে ভাবে কোনো অঘটন ঘটেছে । অবশ্য ওর জায়গায় যেকোনো কেউ থাকলে তাই ই বলবে । একটু এগোতেই ওরা ভিড়ের কারণটা বুঝতে পারলো । আসলে হয়েছে টা কি , যেই দোকানের সামনে এতো ভীড় সেই দোকানে প্রতিটা জামার গুছো পঞ্চাশ পার্সেন্ট অফে বিক্রি হচ্ছে । অশুর বাবা প্রথমে ভাবলো ঢুকবে , কিন্তু যা ভির তাতে এক সেকেন্ড ও দাঁড়ালে ওরা দুজনেই পিসে যাবে । একটু এগিয়ে আশুরা আরেকটা দোকানে ঢুকলো । দোকানের ভিতর কোনের দিকে একটা টুলে গিয়ে আশু বসলো । অশুর বাবা দোকানের মালিকের সাথে কথা বলছে । মালিকের নাম নগেন চন্দ্র কুমার । এনার নাম আশু আগে শুনেছে । এনার থেকেই অশুর বাবা বেশির ভাগ মাল ন্যায়ে । আশু যেইখানে বসে আছে , তার পিছনে আরেকটা ঘর , সেটা বোধহয় গোডাউন । মালিক গোডাউন থেকে একটা ছেলেকে ডেকে দুগোচা জামা নিয়ে আসতে বললো । যেইখানে মালিকটা বসে , তার পিছন দিকে একটা তাকে প্রায় পঁচিশ তিরিষ্টা ডাইরি সাজানো । ওই গুলো বোধহয় পুরোনো পুরোনো হিসেবের ডাইরি । মালিক নগেন কুমার অশুর বাবাকে জামার গুছো গুলো দিয়ে বললো , হরেন তোমার মোট বারোসো টাকা হয়েছে । হরেন মালিককে পাশ্য টাকা দিয়ে বললো , নগেনদা আপনি এই পাশ্য টাকা নিন , বাকি টাকা আমি পুজোর বিক্রির পর দিয়ে দেব । না বাপু , ওই ধার ফার চলবে না , বললো নগেন কুমার । দেখুন না নগেনদা যদি হয়ে , আমি আপনাকে পুজোর পর বাকি টাকা দিয়ে দেব । আপনি তো আমাকে চেনেন । সে বাপু তুমি চেনা হয় বা অচেনা , ওই ধার আর চলবে না , তাতে তুমি মাল নিলে নাও বা ছেড়ে দাও । আজ যেন চেনা লোক ও অচেনা হয়ে গেলো । আশু যেন আর দেখতে পাচ্ছে না । শেষে অশুর বাবা নগেন কুমারের পা অবধি ধর্তে গেলো , কিন্তু কাকুতি মিনতি করেও কিছু লাভ হলো না । আশুরা দুগুচর মধ্যে এক গুছো নিয়ে বেরিয়ে এলো । অশুর খুব খিদে পেয়েছিলো , কিন্তু কিকরে বলবে , ওর বাবার কাছে বাড়ি ফেরার মতো টাকা ছাড়া আর এক টাকাও ছিলো না । আশু হাতে দুগুছো আর হরেন হাতে দুগুছো জামা নিয়ে বাড়ির দিকে রয়োনা দিলো ।
ওদের পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রায় পাঁচটা বেজে গেলো । পৌঁছে , আশু হন্ত দন্ত কোরে ওর টিউশনের ব্যাগ টা নিয়ে গালে দুটো চাল ভাজা পুরে বাড়িয়ে পড়লো । এতো হন্ত দন্ত করার কারণ হলো , আজ আশু পনেরো মিনিট লেট । ক্লাস শুরু হয় পোনে পাঁচটায় আর যেতে লাগে কুড়ি মিনিট । আজ ওর পুজোর আগের শেষ ক্লাস । রাস্তা আজ টুনি লাইট দিয়ে সাজানো হচ্ছে ।অশুদের পাড়ায় সব থেকে বড়ো পুজো হয় অচিন স্মরণীতে । অশুর ঘড়িতে চোখ পড়তেই দেখে পাঁচটা বেজে দশ মিনিট , এখনো দশ মিনিটের পথ । প্রায় সব দোকানি পুজোর জন্য পরিষ্কার করা হচ্ছে । বড়ো বড়ো শপিং মল গুলো আলো দিয়ে রঙিন হয়ে উঠেছে । কি সুন্দর সাজিয়েছে । প্যান্ডেল প্রায় তৈরী হয়ে এসেছে , এবার শুধু ঠাকুর আসার পালা ।
আজ ষষ্টির সকাল । এই কদিনে অশুর বাবার দোকানে তেমন কিছু বিক্রি হয়নি । আজি ওদের আসল ব্যবসা । প্রতি বারের মতো এবারও আশু , ওর বোন ও ওর মা চৌরঙ্গী স্ট্রিটে অশুর বাবার দোকানে গেছে , ভিড়ের সময় সাহায্য করার জন্য । বাজারের পাশে ওদের দোকান । আর বাজারের ঐ ধারে সিটি শপিং মল । এখন ঘড়িতে পাঁচটা বাজে । আশু ! সন্ধে তো হয়েই এলো এই জামা গুলো দিয়ে সামনেটা সাজা তো । আশু এক এক কোরে জামা নিয়ে দড়িতে ঝুলিয়ে দিলো । আশু দেখলো যত সন্ধে হয়ে আসছে ততো যেন শপিং মলটার সুন্দর্য ফুটছে । শপিং মলের গেট টা কি সুন্দর ফুল দিয়ে সাজিয়েছে । নানান রকম রঙিং আলোয় শপিং মলটা ঝিক ঝিক করছে । ঘড়ির কাটায় এখন পনে সাতটা । এবারই আসতে আসতে লোকের ভির বাড়বে । অশুর বাবা দোকানের ভিতরটা একটু একটু গোছাচ্ছে । অশুর খুব ইচ্ছে করছিলো ওদের দোকানটা ঐ শপিং মলটার মতো সাজানোর । শপিং মলের সামনে একটা রঙিং বাল্ব লাগানো । আর মলের দু ধারে একটা সুন্দর লাঠির মতো জিনিসে কত জামাকাপড় সাজানো । অশুর কাছেতো আর ওরম রঙিং বাল্ব নেই যে ও লাগাবে । কিন্তু একটা লাঠি ছিলো , সেটাই ও নিয়ে দোকানের এক ধারে ভালো করে ঝুলিয়ে , অনেক কটা জামা সাজিয়ে দিলো । এখন ঘড়িতে আটটা ছুঁই ছুঁই । একটাও খদ্দের নেই । খদ্দের নেই তার মানে এই নয় রাস্তায় একটাও মানুষ নেই । ষষ্টির দিন আর রাস্তায় ভির হবে না । আসলে পুরো ভিরটাই ওই শপিং মল কেরে নিয়েছে । আজ সিটি মলের সামনে দলে দলে লোক । সত্যি , বলতে আজ কাউরী অশুদের মতন দোকানে ঢুকতে ইচ্ছে করছে না । রাস্তায় প্রায় সবারই হাতে একটা দুটো কোরে সিটি শপিং মলের ব্যাগ । নানা লোক ওদের দোকানের সামনে দিয়ে দু তিন ব্যাগ জামাকাপড় নিয়ে চলে যাচ্ছে । কেউ ফিরেও তাকাচ্ছে না ওদের দিকে । অশুরা এক ভাবে বসে আছে দোকানের ভিতর আর দেখে যাচ্ছে দলে দলে লোক আসছে আর ব্যাগ ভর্তি জামাকাপড় নিয়ে চলে যাচ্ছে । কাউর যেন চোখেই পড়ছে না আশুদের দোকানটা । আজ যেন ওই বড়ো শপিং মলটার কাছে ওদের দোকানটা খুবিই ছোট হয়ে গেছে । অশুর বাবা মুখ ভারি কোরে বসে আছে । আশু বেরিয়ে দেখলো , লোকের ভির যেন আর কমেনা । অশুর কানে এলো লোকে বলে বলে যাচ্ছে , " চল সিটি মল থেকে ঘুরে আসি " । কেউ একবারও ওদের দেকানের নাম প্রজন্ত করলো না । ঘড়ির কাটায় সারে নটা বেজে গেলো , সারা সন্ধে অশুদের দোকানে এক টাকাও বিক্রি হয়নি । অশুর মার মুখ হালকা হালকা কাঁদো কাঁদো হয়ে এসেছে । ষষ্টির দিনেও চোখে জল ! অশুর চোখ থেকে জল বেরিয়ে এলো ।