মঙ্গলবার   ২৬ নভেম্বর ২০২৪   অগ্রাহায়ণ ১২ ১৪৩১   ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অগণিত পাঠকের মনে রয়ে যাবে মো: আবেদ আলির `অন্য গায়ের আখ্যান`

ড. আমিনা খাতুন

পুষ্পপ্রভাত পত্রিকা

প্রকাশিত : ০৯:৪৭ পিএম, ১০ জুন ২০২১ বৃহস্পতিবার

ছোট থেকেই গল্প-দাদুর আসরে বিস্ময় বালকের কৌতুহলী চোখের জিজ্ঞাসা হয়তো আজকের নব্য আধুনিক ছেলেমেয়েদের কাছে অবান্তর ঠেকবে। কিন্তু যখন আমাদের গ্রাম তো আছেই শহুরে বৃত্তেও আধুনিকতা করা নাড়েনি গল্প-দাদুর আসর-ই ছিল আমাদের শিশুমনের একমাত্র মনোরঞ্জনের মাধ্যম। কিছুদিন আগেও রাত্রে মা-ঠাকুমার মুখে আশ্চর্যজনক রোমাঞ্চকর সেই সব গল্প, অদ্ভুত সব জন্তু-জানোয়ার পাখিদের কথা, সাত সমুদ্র তেরো নদী পার করে রাজপুত্রের রাক্ষসের কবল থেকে রাজকন্যাকে উদ্ধার করে নিয়ে যাওয়ার গল্প, ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমীর অলৌকিক মজার গল্প কৌতুহলী কিশোরমনকে পক্ষীরাজের পিঠে স্বপ্নরাজ্যের ভ্রমণ করাতো। শহুরে ইমারতের নব্য আধুনিকতার ব্যস্ততায় সেইদিনগুলি আজকে হয়ত আমাদের কাছেও অচেনা ঠেকবে, কিন্তু কবিগুরুর মতোই প্রশ্ন আসে মনে- আমাদের গেছে যে দিন/ একেবারেই কি গেছে,/ কিছুই কি নেই বাকী ? প্রশ্নটা মনে আসার কারণ, চলতি শহরের কয়েক ক্রোশ দূরত্বে যখন দেখি সেদিনের গল্প-দাদুর আসরের আখ্যান বাস্তবিকেই প্রবাহিত হয়ে চলেছে বর্তমান গ্রন্থটির প্রতিটি পাতায়, গ্রন্থের আখ্যান আমাদের সেদিকেই ফেলে আসা দিনের দিকেই টেনে নিয়ে যায়; যার ভাষা এক, ভাব একই রকম, শুধু পার্থক্য হল এই প্রেক্ষিত অন্যতর।

গ্রন্থলেখক তথা অনবদ্য গল্পকার ‘মো: আবেদ আলি’-র বর্তমান আখ্যানগুলি বর্তমানের ক্যানভাসে বসে অতীতের রঙে ‘সেদিনের জানালা দিয়ে আরেক বর্তমানের কথা বলে, অন্য গাঁয়ের কথা বলে, যেখানে শহুরে জটিল বাস্তবতা নেই, নেই জীবনের পঙ্কিলতাও। আছে গ্রামবাংলার না দেখা এক নতুন সহজ সরল রূপ। গল্পগুলি পড়তে গিয়ে মাটির সোঁদা গন্ধ মনকে যেমন আচ্ছন্ন করে, তেমনি বর্তমান গ্রামীণ সরলতার মধ্যে পুঁতে থাকা অন্য আরেক জটিল বাস্তবতার গ্রামীণ সংস্করণ ও তার অঙ্কুর সম্পর্কে আমাদের অবহিত করে। এমনই আভাস পাই ‘পাঁচু দালালে’র দালালির মাঝে, কাজেমের স্বার্থপরতায়, সাধুবাবার কেরামতির নগ্নতায় আর সাতকড়ির স্বপ্ন ভঙ্গের মাঝে, তবে আশার আলোও দেখি দীলবারের উদারতায়, মাদারের মায়ের ঘোমটা খুলে যাওয়া দেখে, এযুগে বসে ‘আনার মাস্টারের অভাববোধ মনকে তাড়িত করে। ‘মো: আবেদন আলি’ বাস্তবেই সরল ভাষায়, সরল সুরে ‘অন্য গাঁয়ের আখ্যান’ নির্মাণ করেছেন অসাধারণ ভাবে। আর এখানেই গ্রন্থটির অভিনবত্ব।

‘মো: আবেদ আলি’র এই আখ্যানগুলিতে জটিলতার অঙ্কুর থাকলেও সেই জটিলতার কাছাকাছি পৌছাতে পাঠককে জটিল পথ অবলম্বন করতে হবে না লেখকের সহজ বর্ণনার কৌশলীপনাতেই তা সরল হয়ে উঠেছে। কিশাের থেকে বয়স্ক সর্বস্তরীয় মানুষ এই গ্রন্থের প্রতিটি গল্পকে অনুভব করতে পারবেন। জোরের সাথেই বলতে পারি ছােটবউয়ের হেয়ালী উত্তর বা মাদারের মায়ের বায়স্কোপ দেখার অভিজ্ঞতা পাঠকরা পড়ে না হেসে পারবেন না, তা মন যতই ভারাক্রান্ত হোক। অন্তত আধুনিক বাংলা সাহিত্যে এমন আখ্যানক দ্বিতীয়জন আছে বলে আমার জানা নেই। পেশায় ডাক্তার হওয়া সত্ত্বেও কর্মব্যস্ত মানুষটি তার সাহিত্যপ্রেমী সত্তাকে হারিয়ে যেতে দেন নি। বইটি তারই সুপ্ত ব্যক্তিত্বের অনাবিল প্রকাশ। আমি চাই বইটি সবার হাতে গিয়ে পৌঁছাক। জীবনের এক ঘেয়েমিতা দূর করতে, একবার জীবনকে জীবনের মতো করে অনুভব করতে বইটা সবার পড়া প্রয়োজন।

শেষে মো: আবেদ আলি’র সুপুত্র ফারুক আহমেদকে অসংখ্য ধন্যবাদ যার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় আমি তথা অগণিত পাঠক মো: আবেদ আলির মতো এক অসাধারণ সুপ্ত-প্রতিভাকে জানতে পেরেছে। স্বার্থমগ্ন এই পৃথিবীতে সরলতার স্থায়িত্বের স্বার্থেই আমি মন থেকে বইটির ব্যাপক প্রচার কামনা করি। 

প্রকাশক, উদার আকাশ, ঘটকপুকুর, ভাঙড় গোবিন্দপুর, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা-৭৪৩৫০২ মূল্য ৭০ টাকা।

আলোচক: ড. আমিনা খাতুন, বিভাগীয় প্রধান, বাংলা বিভাগ, আধুনিক ভারতীয় ভাষা বিভাগ, আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়, আলিগড়।