শনিবার   ১৬ নভেম্বর ২০২৪   অগ্রাহায়ণ ২ ১৪৩১   ১৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

সমঝোতা হয়নি সংলাপে, দুই পক্ষই অবস্থানে অনড়

জাগরণ প্রতিবেদক

দৈনিক জাগরণ

প্রকাশিত : ০৫:৩৬ পিএম, ৭ নভেম্বর ২০১৮ বুধবার

জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে দ্বিতীয় দফায় সংলাপের মধ্য দিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও জোটের সঙ্গে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও ১৪ দলীয় জোটের সংলাপ প্রক্রিয়া শেষ হয়েছে। কিন্তু সংলাপে সরকার ও বিরোধী দলীয় জোট ঐক্যফ্রন্টের দুই পক্ষের মধ্যে কোনো সমঝোতা হয়নি। শুধু তাই নয়, দুই পক্ষই তার নিজ নিজ অবস্থানে ছিল অনড়।  

বুধবার প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে সংলাপ শেষে সাংবাদিকদের আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, সংলাপ শেষ হয়েছে। তবে চাইলে আবারও নির্বাচনি তফসিল ঘোষণার পর ছোট পরিসরে সরকার দলীয়দের সঙ্গে বিরোধী দল ও জোটের আলোচনা চলতে পারে। 

সংলাপে নির্বাচনের সময় সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্দলীয় উপদেষ্টা সরকার গঠনের প্রস্তাব দিয়েছে ঐক্যফ্রন্ট। এছাড়া বর্তমান নির্বাচন কমিশন ভেঙে দিয়ে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিও সংলাপে তুলে ধরেন ঐক্যফ্রন্ট নেতারা। আওয়ামী লীগ নেতারা সংলাপে বলেন, এসব প্রস্তাব সংবিধানসম্মত নয়। তারা সংবিধানের বাইরে যেতে চায় না। ফলে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ও ১৪ দলের সঙ্গে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের মধ্যে কোনো সমঝোতা হয়নি।  

সংলাপ শেষে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য তোফায়েল আহমেদ বলেন, তারা সংবিধানের পরিপন্থি ও সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কিছু বক্তব্য নিয়ে এসেছে। তাদের এসব বক্তব্য গ্রহণযোগ্য নয়। সংলাপ এখানেই শেষ। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর যদি তারা কোনো বিষয় নিয়ে আবার বসতে চান, সে ক্ষেত্রে আপত্তি নেই।

আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য আমির হোসেন আমু বলেন, ছোটখাটো বিষয় নিয়ে আবারও আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছে ঐক্যফ্রন্ট। কিন্তু তাদের আলোচনার মধ্যে সংবিধানের বাইরে গিয়ে কিছু প্রস্তাব ছিল। যা মেনে নেওয়া সম্ভব হয়নি। তবে তফসিল ঘোষণার পর ছোট পরিসরে আরও আলোচনা হতে পারে। 

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম বলেন, দুই পক্ষই নিজ নিজ অবস্থানে অনড় ছিল। আমরা কোনো ঐকমত্যে পৌঁছতে পারিনি। আমরা স্পষ্টভাবে বলে দিয়েছি, সংবিধানের বাইরে যাওয়ার সুযোগ কোনো নেই। তবে ঐক্যফ্রন্ট আবারও সংলাপের দাবি জানিয়েছে। 

দ্বিতীয় দফায় সংলাপ শেষে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নেতা নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, সংলাপ মনঃপূত হয়নি। সংলাপে কোনো সমঝোতা হয়েছে সমঝোতা হয়নি।

জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মালেক রতন বলেন, সংলাপ শুধু সংলাপই। এর বাইরে তিনি আর কোনো মন্তব্য করেননি।

১৪ দলীয় জোটের শরিক দল ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, সংলাপ ভালো হয়েছে। বিএনপি নির্বাচনে আসবে।

এর আগে সকাল ১১টায় শুরু হওয়া এই সংলাপ শেষ হয় দুপুর ২টার কিছুক্ষণ পর। সংলাপে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ও ১৪ দলের পক্ষে অংশ নেন ১২ জন। অন্যদিকে, ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে সংলাপে ঐক্যফ্রন্টের পক্ষে অংশ নেন ১১ নেতা।

এদিকে, দ্বিতীয় দফা সংলাপ উপলক্ষে সকাল সাড়ে ১০টা থেকেই গণভবনে প্রবেশ করতে থাকেন আওয়ামী লীগ ও ১৪ দল এবং জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতারা। রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করায় জাতীয় ঐক্যফ্রন্টকে অভিনন্দন জানান প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। গণভবনে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে সংলাপে বসে শুরুতেই তিনি ঐক্যফ্রন্টকে এই অভিনন্দন জানান। ১১টার আগেই তারা সবাই ঢুকে যান গণভবনে। এরপর ১১টার দিকে সংলাপের জন্য নির্ধারিত স্থান গণভবনের ব্যাংকুয়েট হলে প্রবেশ করেন শেখ হাসিনা। হাস্যোজ্জ্বল মুখে তিনি শুরুতেই ঐক্যফ্রন্ট নেতাদের উদ্দেশে বলেন, আপনারা তো মঙ্গলবার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করেছেন। আপনাদের অভিনন্দন। এসময় তিনি আবারও তাদের গণভবনে স্বাগত এবং আসার জন্য ধন্যবাদ জানান।

ওবায়দুল কাদের আরও বলেন, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের করা সরকারের নির্ধারিত মেয়াদ শেষে পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন এবং ১০ সদস্যের উপদেষ্টা পরিষদ গঠনের প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে তাদের সাত দফা দাবির বেশ কিছু দাবি মানা হয়েছে। আলোচনা আরও হতে পারে তবে ডায়ালগ শেষ। কিন্তু আমরা সংবিধানের বাইরে যাবো না। নির্বাচন পেছানোর সুযোগ নেই। 

জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সাত দফায় থাকা বেশ কিছু দাবি মেনে নেওয়া হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী তাদের নিশ্চয়তা দিয়েছেন-তফসিল ঘোষণার পর প্রধানমন্ত্রীসহ মন্ত্রীদের গাড়িতে জাতীয় পতাকা ব্যবহার করা হবে না। দলীয় পতাকা থাকবে। কোনও ধরনের সরকারি ফ্যাসিলিটি (সুবিধা) আমরা এনজয় করবো না। তখন সব কিছু থাকবে নির্বাচন কমিশনের অনুরোধে।

নির্বাচনে সেনাবাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেওয়ার আহ্বান মেনে নেওয়া হয়নি উল্লেখ করে তিনি বলেছেন, এটা এখন কোথাও থাকে না। তবে নির্বাচনে সেনা মোতায়েন থাকবে। তারা নির্বাচন কমিশনের প্রয়োজন অনুযায়ী স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে কাজ করবে। 

সাত দফার কী কী দাবি মেনে নেওয়া হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, নির্বাচনে লেভেল প্লেইং ফিল্ডের ব্যাপারে আমরা সম্মত। সরকারি পতাকা ও সরকারি কোনও ফ্যাসিলিটি আমরা এনজয় করবো না। তারা রাজবন্দিদের একটা তালিকা দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী আইনমন্ত্রীকে বলেছেন, যদি এই তালিকায় রাজবন্দি কেউ থেকে থাকে তাহলে তাদের মুক্তি দিয়ে দিতে। তারা সভা সমাবেশ করতে পারবেন। বিদেশি পর্যবেক্ষকের ব্যাপারে আমাদের কোনো আপত্তি নেই।

আলোচনা শেষে প্রধানমন্ত্রী তাদের সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে ব্যক্তিগত পর্যায়ে আলোচনা করে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার অনুরোধ করেছেন। নির্বাচন পেছানোর নামে কোনো অপশক্তি আর যেন ক্ষমতায় আসতে না পারে সে বিষয়েও সবাইকে লক্ষ্য রাখতে অনুরোধ জানিয়েছেন তিনি।

বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি বিষয়ে কী আলোচনা হয়েছে জানতে চাইলে ওবায়দুল কাদের বলেন, খালেদা জিয়া ও কয়েকজন সাবেক মন্ত্রীর ব্যাপারে কথা হয়েছে। তারা তাদের মুক্তি চাননি, জামিন চেয়েছেন। আমরা বলেছি, এই মামলটি করেছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার, ক্যালেন্ডারে দেখতে দেখতে ১১ বছর পার হয়েছে। এই মামলা নিষ্পত্তি করতে ১১ বছর পার হয়েছে। তারা এ মামলা নিষ্পত্তি করতে আগ্রহী ছিলেন না। এখন আদালত যদি জামিন দেয় তাহলে আমাদের আপত্তি নেই। 

তিনি বলেন, গত ১ নভেম্বর থেকে শুরু হওয়া সাত দিনে যত সংলাপ হয়েছে সেসব বিষয় নিয়ে বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংবাদ সম্মেলন করে বিস্তারিত জানাবেন।

সংলাপে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ও ১৪ দলের নেতাদের মধ্যে অংশ নিয়েছিলেন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমু ও তোফায়েল আহমেদ, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও ১৪ দলের মুখপাত্র মোহাম্মদ নাসিম, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম, ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ডা. দীপু মণি,  আইন বিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট শ ম রেজাউল করিম ও দফতর সম্পাদক ড. আবদুর সোবাহান গোলাপ।

জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে প্রতিনিধি দলে ছিলেন বিএনপি মহাসচিব ও ঐক্যফ্রন্টের মুখপাত্র মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশারফ হোসেন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) সভাপতি আ স ম আবদুর রব, সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মালেক রতন, গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মোহসীন মন্টু, নির্বাহী সভাপতি অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী, নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না, এস এম আকরাম, জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার নেতা সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমদ।

এসআর/এফসি