মঙ্গলবার   ২৬ নভেম্বর ২০২৪   অগ্রাহায়ণ ১২ ১৪৩১   ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

নির্বাণ ছবিটি নিয়ে কিছু কথা... অশোক মজুমদার

পুষ্পপ্রভাত পত্রিকা

প্রকাশিত : ০১:৫২ পিএম, ১৩ মার্চ ২০২০ শুক্রবার

নির্বাণ ছবিটি নিয়ে কিছু কথা...

অশোক মজুমদার   

বলা দুরকম হয়, একটা তত্ত্ব ও শ্লোগান দিয়ে বলা আরেকটা জীবন দিয়ে বলা। গৌতম হালদারের নির্বাণ ছবিটা হল জীবন দিয়ে বলা একটা গল্প। প্রথমবার ছবিটা  দেখেছিলাম এবারের কলকাতা  চলচ্চিত্র উৎসবে। সম্প্রতি টালিগঞ্জের ফিল্ম সার্ভিসে গৌতমদার স্টুডিওতে ছবিটা আরেকবার দেখার সুযোগ হল। তাই এ নিয়ে কিছু কথা বলার লোভ সামলাতে পারলাম না। আমার মতে, নির্বাণ এই সময়ের একটা গুরুত্বপূর্ণ ছবি। শুধু রাখী গুলজার এ ছবিতে ২১ বছর পর অভিনয় করেছেন বলে নয়, ধর্মান্ধতা ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে এ ছবি যে বার্তা দিয়েছে তা দেশের প্রতিটি প্রান্তে পৌঁছে দেওয়ার জন্য ছবিটি বাণিজ্যিকভাবে প্রদর্শিত হওয়া দরকার। 

নির্বাণ সাহস ও সংস্কার দুটোই আছে এমন এক বৃদ্ধার ঘটনা ও দুর্ঘটনার সিঁড়ি বেয়ে একটা নতুন উপলব্ধিতে পৌঁছনোর কাহিনি। মতি নন্দীর ‘বিজলিবালার মুক্তি"" গল্পটি অবলম্বনে নির্মিত এই ছবিটিতে বৃদ্ধাটি যেন সর্ব বন্ধন থেকে মুক্তি পেয়ে নির্বাণ লাভ করলেন। আমাকে সবচেয়ে যেটা বেশি অবাক করেছে তা হল ছবিটির পটভূমি নির্বাচন। বাগবাজার, কুমোরটুলি, বেনেটোলা, আহিরীটোলা সংলগ্ন গঙ্গা ও তার লাগোয়া পুরনো বাঙালি পাড়ার অলিগলিতে একটা দম আটকানো স্থবিরতা ও পিছুটান যেন জাঁকিয়ে বসেছে। সেই এলাকারই এক বৃদ্ধা নিজের বিশ্বাস ও সংস্কারের জটগুলো খুলতে খুলতে এক সত্যে পৌঁছে গেলেন। নির্বাণ সেই যাত্রার কাহিনী।

নিজের বাড়িতে নাম ভাঁড়িয়ে বাস করা হাসির দেওয়া রক্তেই বেঁচে ওঠেন বিজলীবালা। পরে জানা যায় সে মুসলমান। জীবনের সরল সত্যটি মেনে নিতে চান তিনি। সাম্প্রদায়িক বিভেদ যে কত অর্থহীন তা তার পুজো করা নারায়ণ শিলা নিয়ে খেলতে খেলতে বুঝিয়ে দেয় হাসির ছেলে ভুটু। ছবির কোন চরিত্রই জাতপাত-সাম্প্রদায়িকতা-ধর্মান্ধতা নিয়ে কোন বক্তৃতা দেয়নি কিন্তু ঘটনার মধ্যে দিয়ে দর্শকরা বুঝে যান জীবনের আসল সত্য। দালানে মুসলমান বা অন্য জাতের লোকরা বসলে যে বৃদ্ধা দালান ধুইয়ে দেন সেই মহিলাই একটু একটু করে মনুষ্যত্বের কাছে নতজানু হয়ে নিজেকে একেবারে বদলে নেন। নির্বাণ সেই উত্তরণের গল্প।  

নির্বাণ ছবিতে কোন অভিনয় নেই, আছে আচরণ। বিদিতা বাগ, চৈতি ঘোষাল, সমদর্শী দত্ত সবাই তাদের অভিনীত চরিত্র অনুযায়ী আচরণ বা ‘বিহেভ’ করে  গেছেন। আর রাখী গুলজার তার অভিব্যাক্তি ও অভিনয় দিয়ে প্রতিটি ফ্রেমে পর্দাকে করেছেন  শাসন। আমার প্রিয় লেখক মতি নন্দী ‘বিজলীবালার মুক্তিলাভ’ লিখেছিলেন বহু বছর আগে। অথচ আজকের ভারতে তা আরও বেশি সত্য। রাখী গুলজার পর্দায় এলেন ২১ বছর পরে, কিন্তু এখনও তার কী অভিব্যাক্তি!

এমন একটি বিষয় নিয়ে ছবি করার সাহস দেখিয়েছেন বলেই পরিচালক গৌতম হালদারকে স্যালুট করতে হবে। তিনি জাতপাত-সাম্প্রদায়িকতার সমস্যার মূল জায়গাটাতেই হাত রেখেছেন। এমনভাবে সাজিয়েছেন ঘটনাক্রম যাতে মনে হচ্ছে এ তো আমাদের সবার চেনা গল্প। আমার জীবনে বা আমার পাড়ায়ও তো এমনটাই ঘটেছিল। ছবি মানেই একটা বাণিজ্য কিন্তু পরিচালকদের একটা সামাজিক দায়িত্বও থাকে। গৌতমদা সে কাজে পুরোপুরি সফল।  

ফিল্ম সার্ভিস স্টুডিওতে খুবই ঘরোয়া পরিবেশে ওস্তাদ রশিদ খান, পণ্ডিত তেজেন্দ্রনাথ মজুমদার, পণ্ডিত অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়, শিক্ষাবিদ ডক্টর স্বপন দত্ত, কৃষি বিজ্ঞানী সত্যদা’র সঙ্গে ছবিটা দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল নির্বাণ আমাদের আজকের ভারতে এক জ্বলন্ত সত্যের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। করমুক্ত করে  সাব টাইটেল সহ ছবিটি দেশের প্রতিটি প্রান্তে প্রদর্শনের ব্যবস্থা করলে খুব ভাল হয়।

অশোক মজুমদার