বৃহস্পতিবার   ১৪ নভেম্বর ২০২৪   কার্তিক ৩০ ১৪৩১   ১২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অঙ্কিতা চ্যাটার্জী কলম

ন্যানো গ্রাম বিষ : কবি আত্মা ও কাব্য আত্মা

অঙ্কিতা চ্যাটার্জী

পুষ্পপ্রভাত পত্রিকা

প্রকাশিত : ১১:১৬ পিএম, ৭ ফেব্রুয়ারি ২০২০ শুক্রবার

পুস্তক সমালোচনা 

একজন মানুষ কেন কবিতা লেখেন তা আমাদের জানা নেই ! বিবিধ কবি বিবিধ উত্তর দিয়েছেন এযাবৎকাল, কিন্তু সব উত্তরই আপেক্ষিক ! ব্যক্তির চালচিত্রের সঙ্গে, যাপিত জীবনের সত্তার সঙ্গে কাব্যভাবনা পাল্টে যায়। তবে একটি বিষয় সত্য - সৎ, বিবেকবান, আদর্শনিষ্ঠ ও সমাজ সময়ের প্রতি দায়বদ্ধ মানুষই কবিতার কাছে নতজানু হয়ে বসেন। কবি ব্যক্তিজীবনে সৎ না অসৎ তা  আমাদের জানার দরকার নেই কিন্তু প্রতিটি কবিই তাঁর কবিতার কাছে সৎ, মহৎ ও আদর্শনিষ্ঠ  একথা বলাবাহুল্য। বাংলা কাব্য সাম্রাজ্যে আরও একটি সংযোজন ন্যানো গ্রাম বিষনিয়ে আমারা এই আলোচনায় অবতীর্ণ হব। পাঠকের গোচরার্থে জানানো যেতে পারে কাব্যটি প্রকাশিত হয়েছে বাংলাদেশের কবি মানসপ্রকাশনী থেকে। ৬৪ টি কবিতার সমাহারে গ্রন্থটি সম্পূর্ণ।

 প্রথমেই বলে নেওয়া ভালো কবিতাগুলি বাংলা বর্ণমালার অক্ষর অনুসারে লিপিবদ্ধ, ‘থেকে পর্যন্ত। কবি যেন আমাদের আরও একবার বর্ণমালার পাঠক্রম মনে করিয়ে দিলেন। বলা ভালো বর্ণমালার দিব্যি নিয়ে বাংলা কাব্যযাত্রা শুরু করলেন। প্রথম কবিতায় নিজেকে পরিচয় দিলেন অক্ষর চেলাহিসাবে। কবি তো অক্ষরের হাত ধরেই সীমা থেকে সীমাতীতে পৌঁছে যেতে চান। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেকে বলেছিলেনকলম পেষা মজুরযিনি প্রকৃত কবি তিনি অক্ষরশিল্পী। যার মজ্জায় মজ্জায় কবিতা তিনি তো অক্ষরকেই প্রণাম করবেন। কবির কাছে অক্ষর যেন বিশ্বকর্মার অস্ত্রশালা। এই অক্ষরের টানই যেন কবিকে ঘর ছাড়া করেছে। নিয়ে গেছে কোলাহল থেকে নির্জনতায় –‘যত দিন বাঁচি / তবু, তোমার অক্ষর-চেলা হয়ে যেন বাঁচি কিন্তু অক্ষর তো আঘাত করে। ভিতরের এক যন্ত্রণাবোধই যেন কবিকে দিয়ে লিখিয়ে নেয়। সে যাপনের কোন অর্থ নেই। গভীর জীবনদর্শন, সমাজ ইতিহাসই যেন কবির হাতে কলম তুলে দেয়। লিখিয়ে নেয় আত্মযাপনের কথামালা –‘আসলে অক্ষরমালা তো জানার কথা নয় / আমার, তোমার বেদে পরম্পরা জীবনেতিহাস।পরাবাস্তবতা, ফ্যান্টাসি, রূপকথা, লোককথা মিলেই কবি প্রবেশ করেন সময়বিশ্বে। যেখানে মানুষ বহন করে চলেছে দেশভাগের ক্ষত।

                             মিথের নবনির্মাণে অবতীর্ণ হন অহল্যাকবিতায়। মিথের সঙ্গে মিশে গেছে লোকায়ত জীবন, হুদুম উৎসব। যে প্রকৃতির কোলে আশ্রম গড়ে উঠেছিল, যে প্রকৃতির শিক্ষার কথা ভেবেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, সেই শান্তিনিকেতনও আজ খাঁচার বন্ধ। শব্দের দ্বৈত ব্যঞ্জনা নিয়ে হাজির হন -কাশকবিতায়। কাশ ফুল যেন মিশে গেছে রঙের আকাশের সঙ্গে। কবিও সেই সুযোগে শরতের বার্তা জানিয়ে দেন। এই পৃথিবীর দুঃখ-বেদনার মধ্যেই প্রকৃতি আপন খেয়ালে জেগে ওঠে, নিজের সুর জানান দেয়। গ্রাম্য জীবন আছে, রাখাল ছেলে আছে, ভাসমান প্রকৃতির খেয়াল আছে, কবির দেখা আছে, স্বপ্ন বুনে চলা আছে–‘আলের মাথায় দু-একটি থোপ কাশ / সেই আমাদের শরতের আগমনী আকাশ এক নৈরাজ্যের অন্ধকারের স্বর্গসুখের সামনে আমরা দাঁড়িয়ে আছি। সেখান থেকে আমাদের পরিত্রাণ নেই, কবিরও পরিত্রাণ নেই। কিন্তু কবির হাতে আছে কলম, তিনি বুনে চলেন শিল্পের রূপকথা। রাষ্ট্র, শোষক সর্বদা প্রতিবাদীর কণ্ঠরোধে ব্যস্ত। মুখ ও মুখোশ যেন কোথায় মিলে যাচ্ছে। মুখোশ যেন আজ মুখের সামনে পর্দা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কবি তখন কবিতা লিখে চলেন, প্রতিবাদ বর্ষণ করেন –‘খোলা চোখেও চারদিক অন্ধকার / কী সুখ ! মুখোমুখি এ ওর মুখোশ দেখি। শৈশবের স্মৃতিতর্পণ করেছেন আমার তোর্ষা ও তিস্তাকবিতায়। মনের খাতায় যে সুর জেগে উঠেছে তাই যেন বেজে ওঠে। শব্দ বোনে। এ দুই নদী যেন কবির দুই হৃদ্‌পিন্ড, নাভিশ্বাস, ইরা পিঙ্গলা।

                                  সত্যতার বুকে চাবুক হানেন আমিও পাথর হয়ে যাবকবিতায়। শিক্ষাই শিক্ষাহীনতার বড় কারণ বুঝি। তথ্য প্রযুক্তি ও শিক্ষার নবিনীকরণ আজ দেশকে ধ্বংসের বুকে নিয়ে গেছে। সেখান থেকে কবির ঘোষণা –‘আমার পলি হৃদয় পাথর জন্মের বয়স লিখে রেখো / পাথরে পাথর ঘষে বশ্যতাহীন দাবানল এ কবিও আলোর সন্ধানে যান। অন্ধকারের গোপন হৃদয় থেকে যে আলোর ঝর্ণা সেই তো কবির চাওয়া –‘আলোর পোশাকে এসেছি দেখো / তোমার ওপর পুরো পারাপার / কতটা আমাকে ভেজাবে বল ?’ সময়ই তো সময়ের বড় নিয়ন্ত্রক। সময়ই তো ঠিক করে দেয় কার হাতে ধাকবে সভ্যতার চালিকা শক্তি। মানুষ যেন সেখানে অনুঘটক মাত্র। তাই কবিকে লিখতে হয় ইঁদুরতন্ত্রকবিতাএই একবিংশ শতকের নগরায়ণের যুগে এসে আমরা কি দাবি করতে পারি সভ্যতা খুব বেশি এগিয়ে গেছে ? নিজেদের মন থেকে ধর্মান্ধতা, কুসংস্কারের বীজ কি সব উপড়ে ফেলতে পেরেছি ? বিপন্ন সময়, ঘোর বাস্তবতা ফিরে আসে –‘নেংটি ইঁদুর ধেরে ইঁদুর / এরাই স্বজন, এরাই বিদুর

                                  আজ সব দোষ নেমে এসেছে বুদ্ধিজীবীর ওপর। কিছু ঘটলেই যেন পথে নামতে হবে বুদ্ধিজীবীদের। তাঁদের যেন রুচি-অরুচি বোধ নেই। জনগণের ভালো বোঝাই যেন তাঁদের ভালো বোঝা, পরিচয়। তাই কবিকে লিখতে হয় ইন্টারনাল মেমোরিকবিতা, আধুনিক জীবনের শব্দকে আয়ত্ত করতে হয়। একজন কবির অভিলাস, জীবনের অন্তিম ও শ্রেষ্ঠতম ইচ্ছা ব্যক্ত হয়েছে কবিতাযাপন ও আমার জন্মমাটি কবিতায়। অমৃত ভক্ষণ নয়, কবিতা দিয়েই যাপনের দিবস-রজনী সাজাতে চেয়েছেন। একজন প্রকৃত কবির কাছেই আমাদের সেটাই তো প্রাপ্য –‘লিখে যাই, ডুবে যাই কবিতায় সারাক্ষণ /... এভাবে আমিও যেন কবিতায় জাগি, কবিতায় রাগী, কবিতায় হাঁটিরোমান্টিকতা, ফ্যান্টাসি, পরাবাস্তবতার পাশাপাশি বক্তব্য প্রধান কবিতাও লেখেন। পাট্টা প্রথা, দেশভাগ থেকে শোষণ, প্রতিবাদ বর্ষিত হয়। ধ্বনিত হয় একতার বাণী। নতুন প্রজন্মকে পথে নামার আহ্বান জানান। বুঝিবা নতুন প্রজন্ম এভাবেই পথে নামবে। তাই খেলাকবিতা এক নতুন ইমেজ নিয়ে হাজির হয়। প্রতিটি কবিতাই কবি যাপনের রুদ্ধশ্বাস স্বপ্ন থেকে লিখেছেন। চিহ্নতত্ত্ব, শূন্যতার দর্শন, উত্তরাধিকারের সন্ধান থেকে যেমন গোলকবিতা লেখেন তেমনি চিত্রকল্পকবিতায় প্রেম, প্রকৃতি, ইমেজ, চিত্রকল্প সব মিশে যায়।  পাঠক মনে কবিতাগুলি একটা ছাপ রেখে যাবে একটা সহজেই বলা যায় !

 

লেখিকা - বেলাকবা গার্লস হাই স্কুলের শিক্ষিকা।