এলাম বাংলাদেশ থেকে
শিবব্রত গুহ
পুষ্পপ্রভাত পত্রিকা
প্রকাশিত : ০৫:৫২ পিএম, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০২০ বুধবার
অনেকদিন থেকেই বাংলাদেশ যাব যাব করেও
যাওয়া হচ্ছিল না। অবশেষে, বাড়ি থেকে বেড়িয়ে
পড়লাম আমি বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে। বাংলাদেশ যাওয়ার ভিসা আগেই করে রেখেছিলাম। কোলকাতার শিয়ালদহ স্টেশন থেকে গেদে লোকাল ট্রেনে চেপে সোজা গেদেতে পৌঁছে
সেখানে বিএসএফ চেকিং শেষে দর্শনা বর্ডার দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করলাম।
বাংলাদেশে প্রথম দেখলাম রায়েশার বিল। বিলের
সৌন্দর্য আমাকে মুগ্ধ করলো। দর্শনায় আছে একটি বড় সুগার মিল। অনেকটা জায়গা জুড়ে
এই মিলটা আছে। বাংলাদেশে প্রথম যে জেলায়
গেলাম আমরা তার নাম চুয়াডাঙ্গা। আমরা মোট
১১ জন মিলে বাংলাদেশে গিয়েছিলাম। ভারতের স্বাধীনতার আগে, বাংলাদেশের কার্পাসডাঙ্গায় এক মাটির বাড়ীতে এসে বেশ কিছুদিন ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি নাকি এই মাটির
বাড়ীতে বসে তাঁর বিখ্যাত " লিচুচোর " কবিতাটি
লিখেছিলেন। এই মাটির বাড়ীটা দেখবার মতো।
বিদ্রোহী কবির পদধূলিধন্য বাড়ীতে আসতে পেরে
নিজেকে ধন্য মনে করলাম।
এর একটু দূরেই কুলকুল করে বয়ে চলেছে ভৈরব নদী। শোনা যায়, এই নদীর কূলে বসে কবি নজরুল কিছু গান লিখেছিলেন। বাংলাদেশের
বাস সার্ভিস খুব ভালো আর বাসের সংখ্যাও অনেক। কার্পাসডাঙ্গা চার্চ দেখবার মতো। এখান
থেকে আমরা গেলাম কুষ্টিয়া জেলায়। কুষ্টিয়াতে
একটা জিনিস দেখে আমি ভারী অবাক হলাম।
ওখানে রাস্তার দুধারে শুধু সারি সারি রাইস মিল।
এত রাইস মিল একজায়গায় আমি এর আগে
কখনো দেখেনি।
এবারে দেখলাম বাংলাদেশের বিখ্যাত নদী পদ্মাকে। এই পদ্মার কথা আমি এর আগে
অনেক শুনেছিলাম। আজ নিজের চোখে
দেখলাম। আমার দুচোখ সার্থক হল।
পদ্মার রূপ বর্ণনা করার মতো ভাষা আমার
নেই। এই পদ্মার ইলিশ জগৎ বিখ্যাত।
এর স্বাদ আমি এর আগে চুয়াডাঙ্গাতেই পেয়েছিলাম। এই পদ্মা নদীর ওপর
পাশাপাশি আছে লালন শাহ সেতু ও
হার্ডিঞ্জ ব্রীজ। দুটি সেতুই দারুণ।
এই হার্ডিঞ্জ ব্রীজ হল বাংলাদেশের বৃহত্তম
রেলসেতু। হার্ডিঞ্জ সাহেবের নামে এর
নামকরণ হয়েছিল। এর বয়স একশো বছরেরও
বেশি। বাংলাদেশে সবচেয়ে ভালো লেগেছে যে জায়গাটা সেটা হল শিলাইদহ কুঠিবাড়ী। এই
কুঠিবাড়ীটি দোতলা। এটি দেখতে বড় সুন্দর।
এর একপাশে আছে একটি পুষ্করিনী। সেই পুষ্করিনীর এক কোনে রয়েছে একটি ভাঙাচোরা
বজরা। এই বজরাতে চড়ে কবিগুরু ভ্রমণ করতেন
ও তাঁর অনন্য সৃষ্টি রচনা করতেন। এই বাড়ীর
দেয়ালে দেয়ালে সাজানো আছে রবীন্দ্রনাথের ছবি দিয়ে। এখানে তাঁর ব্যবহৃত পালঙ্ক, টেবিল,
রান্নাঘর প্রভৃতি রয়েছে। এসব দেখে আমার
মনে এক অদ্ভুত শিহরণ খেলে গেল।
কুষ্টিয়াতে আছে বাংলাদেশের বিখ্যাত লেখক
মীর মশাররফ হোসেনের জন্মস্থান। তাঁর রচিত
বিখ্যাত ট্র্যাজেডি গ্রন্থের নাম হল "বিষাদ সিন্ধু"।
এখানে লেখকের নামাঙ্কিত একটি মাধ্যমিক
বিদ্যালয় আছে। এছাড়া, এখানে রয়েছে
মীর মশাররফ সংগ্রহশালা ও অডিটোরিয়াম।
সংগ্রহশালাটি দেখবার মতো। এখান থেকে লেখকের জীবনের অনেক তথ্য আমরা
পেলাম।
কুষ্টিয়ার অন্যতম দর্শনীয় স্থান হল লালন
শাহের মাজার। এর প্রবেশদ্বার বিরাট উঁচু।
এখানে বিখ্যাত বাউল লালন শাহের সমাধি
রয়েছে। তার সমাধি সৌধ দেখবার মতো।
অপূর্ব তার কারুকাজ। লালন শাহের সমাধির
আশেপাশে আছে তাঁর সঙ্গীসাথী বাউল -
ফকিরদের সমাধি। এখানকার ভাবগম্ভীর
পরিবেশ মনকে মুগ্ধ করে। এখানে একটি বড়
অডিটোরিয়াম রয়েছে। এই অডিটোরিয়ামে
বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বাউল -
ফকিরেরা এসে সংগীত পরিবেশন করে থাকে।
এখানে আছে একটি একাডেমিক ভবন। এই ভবনের লালন মিউজিয়াম অনন্যসাধারণ।
এই মিউজিয়াম দেখলে লালনের জীবন
সম্বন্ধে অনেক জ্ঞান অর্জন করা যায়।
বাংলাদেশের পাবনা একটি বড় সাজানো
গোছানো শহর। এখানে দেখলাম বাংলাদেশের বিখ্যাত রিক্সা। রাজধানী ঢাকার মতো অত
সুন্দর না হলেও এই রিক্সাগুলো বেশ ভালোই।
পাবনাতে চার্চ, ব্রিটিশ আমলের জেলখানা, মসজিদ বাড়ি দেখবার মতো। এখানকার যাতায়াত ব্যবস্থাও ভালো। পাবনার দই ও
বগুড়ার সরপড়া দই বিখ্যাত। এই দুই ধরনের
দই খাওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। এর স্বাদ
অপূর্ব।
পাবনা শহরে আছে বাংলা চলচ্চিত্রের মহানায়িকা
সুচিত্রা সেনের বাড়ী। বর্তমানে, বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগে এই বাড়ী সুচিত্রা সেন স্মৃতি
সংগ্রহশালাতে রূপান্তরিত হয়েছে। বেশ অনেকটা
জায়গা জুড়ে এই সংগ্রহশালা। এর সামনে আছে
একটা ছোটখাটো বাগান। এই বাগানে ফুটে রয়েছে নানা রকমের জানা অজানা ফুল।
এই সংগ্রহশালাতে সুচিত্রা সেনের জীবনের
নানা স্মৃতি সুন্দরভাবে সংরক্ষিত আছে।
পাবনা শহর থেকে একটু দূরে রয়েছে হিমাইতপুর
গ্রাম। নামেই গ্রাম, কিন্তু, দেখে মোটেই বোঝার
উপায় নেই , যে এটা গ্রাম না শহর! এখানেই অনেকদিন আগে জন্মগ্রহণ করেছিলেন সৎসঙ্গের
প্রতিষ্ঠাতা পরমপ্রেমময় ঠাকুর অনুকূলচন্দ্র। এখানে আছে অনুকূল ঠাকুরের আশ্রম। এই আশ্রমের দুটি প্রবেশদ্বার। বিরাট জায়গা জুড়ে
এই আশ্রম অবস্থিত। এখানে অনুকূল ঠাকুরের বাবা মায়ের সমাধি মন্দিরটি দেখবার মতো।
অসাধারণ তার কারুকাজ। এছাড়া, অনুকূল
ঠাকুরের মন্দিরটিও ভালো। এই আশ্রমের একধারে একটি বড় পুকুর আছে। এর নাম
অনুকূল সায়র। এছাড়া, এখানে গেস্ট হাউসও
রয়েছে।
একটা কথা তো বলাই হয়নি, পাবনাতে থাকার জন্য অনেক ভালো হোটেল আছে। হোটেল
ভাড়া মোটামুটি বাংলাদেশী মুদ্রায় দিনপ্রতি
৮০০ - ১০০০ হাজার টাকার মধ্যে। আমরা
সবাই পাবনাতে যে হোটেলে ছিলাম তার
নাম " আল - জেহাদ"। হোটেলটি বেশ ভালোই।
এবার নিজের দেশ ভারতে ফেরার পালা। একটা
জিনিস দেখে আমি সত্যিই অবাক হলাম,
বাংলাদেশের যেখানেই গেছি, সেখানেই
মানুষের ভালো ব্যবহারে মুগ্ধ হয়েছি। সত্যিই,
এ আমার কাছে এক বিরাট পাওয়া। মনটা
ভারাক্রান্ত হয়ে গেল। দর্শনা বর্ডার পেরিয়ে
ভারতে প্রবেশ করলাম আমরা সবাই।
বিদায় বাংলাদেশ, বিদায়।