ভয়াবহ অগ্নিকান্ড
ঢাকায় ভয়াবহ আগুনে লাশের মিছিল
বাংলাদেশ প্রতিনিধি
পুষ্পপ্রভাত পত্রিকা
প্রকাশিত : ০৮:৩২ পিএম, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ বৃহস্পতিবার
পুরান ঢাকার চকবাজারে রাজ্জাক ভবনে লাগা আগুনে পুড়ে গেছে সব। চলছে উদ্ধার কাজ। ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার চকবাজার এলাকায় একটি বহুতল ভবনে গতকাল বুধবার রাতে লাগা আগুনের ঘটনায় নিহত মানুষের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। আজ বৃহস্পতিবার সকাল আটটায় শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ৬৯ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস। পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) জাবেদ পাটোয়ারী সকাল সাড়ে আটটার দিকে ব্রিফিংয়ে জানান, ৭০ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। আরও লাশ থাকতে পারে। উদ্ধারকাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত লাশের সংখ্যা জানা যাবে না বলছে ফায়ার সার্ভিস। লাশগুলো ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়েছে। তবে এই সংখ্যা আরও বাড়ার আশঙ্কা করছেন স্থানীয় লোকজন। পুড়ে যাওয়া লাশগুলো এখনো শনাক্ত করা যায়নি।গতকাল রাত ১০টা ১০ মিনিটে নন্দকুমার দত্ত সড়কের চুরিহাট্টা মসজিদ গলির বহুতল ভবনটিতে আগুন লাগে। রাতে পৌনে একটার দিকে পাশের কয়েকটি ভবনে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। চকবাজার এলাকার গ্যাস লাইন থেকেও ওই সময় আগুন বের হচ্ছিল। অগ্নিকাণ্ডের পর ওই এলাকার বিদ্যুৎ–সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভবনটির নিচতলায় রাসায়নিক দ্রব্যের কারখানা ছিল।ঘটনাস্থল থেকে থেমে থেমে বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। রাতে স্থানীয় বাসিন্দাদের কয়েকজন জানান, ভবনটির পাশে বেশ কিছু রেস্তোরাঁ রয়েছে। যেগুলোর প্রতিটিতে চার থেকে পাঁচটি করে গ্যাসের সিলিন্ডার রয়েছে। আগুন ছড়িয়ে যাওয়ার কারণে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ হতে পারে।
ফায়ার সার্ভিসের ৩৭টি ইউনিট রাত তিনটায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। সরু গলি হওয়ার কারণে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে পারেনি। চকবাজার থানার সামনে গাড়ি রেখে সেখান থেকেই পাইপের মাধ্যমে পানি দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া আশপাশের ভবনের পানির ট্যাংক থেকেও ফায়ার সার্ভিস পানি সংগ্রহ করেছে।
ফায়ার সার্ভিস বলেছে, সকাল আটটা পর্যন্ত আগুন পুরোপুরি নেভানো সম্ভব হয়নি। থেমে থেমে বিস্ফোরণের শব্দও পাওয়া যাচ্ছে। আগুন পুরোপুরি নেভাতে আরও সময় লাগবে বলে ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে।
ঢাকার চকবাজারে কসমেটিকসের ব্যবসা করেন ফিরোজ। তার ভাই হীরা মারা গেছে আগুনে। তার দাবি পুরো ঘটনাই তার চোখের সামনে ঘটেছে। পুরনো ঢাকার চকবাজারের ব্যস্ত এলাকায় চুড়িহাট্টায় যে ভবনে আগুনে লেগেছে তার থেকে তিনটি বাড়ি দূরে কসমেটিকস ব্যবসায়ী ফিরোজ থাকেন। তিনি জানিয়েছেন যে আগুনে তার ভাই হীরা মারা গেছে। "এছাড়া এই এলাকায় নিয়মিত যাদের সাথে আড্ডা দেই বন্ধু-বান্ধব সব মিলিয়ে অন্তত ২৫ জনের খোঁজ পাচ্ছিনা। সব মৃতদেহ এখনো দেখতে পারিনি"। মিস্টার ফিরোজ বলেন, আগুন লাগার ঘটনাটি তিনি নিজেই দেখেছেন, কিন্তু এমন হবে তা ভাবতে পারেননি। "ঘটনাটা রাত ৮:৪৫ মিনিটের দিকে। চুড়িহাট্রার ওই কোনায় রাস্তায় একটি মাইক্রোবাস দাঁড়ানো ছিলো।" "উপরে ছিলো বিদ্যুতের ট্রান্সফরমার। হঠাৎ ট্রান্সফরমার বিস্ফোরণ হয়ে মাইক্রোবাসটিতে পড়ে। এর মাইক্রোবাসের সিলিন্ডার বিস্ফোরণ হয়ে পাশে কেমিক্যাল দোকান ছিলো সেখানে লেগে গেলে মুহুর্তের মধ্যে তা পুরোপুরি ছড়িয়ে যায়।" যদিও ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশ উভয় পক্ষই বলেছে 'ওয়াহিদ ম্যানশন' নামে একটি ভবনের বেজমেন্টে কেমিক্যাল মজুত ছিলো। ফিরোজ বলছেন, ওয়াহিদ ম্যানশন এরপর প্লাস্টিকের মার্কেটে আগুন ছড়িয়ে পড়লো আরো বেশি। আর ওদিকে ক্যামিকেল মজুতে একটার পর একটা বিস্ফোরণ। "এভাবে আশে পাশের ৮/১০ টা দোকান। যতই পানি মারে আরও তা বিকট হয়। ওয়াহিদ ম্যানশন, হায়দার মেডিকেল, হোটেলে আগুন লেগে যায়। বন্ধু-বান্ধব সার্কেলের ২৫ জনকে পাচ্ছিনা।" তিনি বলেন, ফার্মেসিতে থাকা লোকজন ভেবেছিলো সামনে কেউ বোমা মেরেছে এবং এই ভেবে তারা দোকানের শাটার বন্ধ করে দেয়। "আমার ভাই ফার্মেসির মধ্যে ছিলো। শাটার বন্ধ করেছিলো ভয়ে। আশঙ্কা করছি তারা ভেতরেই মারা গেছে কিনা। ভোর ৫টা পর্যন্ত টানা অপেক্ষা করেছি কিন্তু মৃতদেহ পাইনি।"
ভয়াবহ আগুনের ঘটনায় নতুন করে আলোচনায় এলো মুগল আমলে গড়ে ওঠা ঢাকার এককালের প্রাণকেন্দ্র চকবাজার। যদিও পুরনো ঢাকায় এমন দুর্ঘটনা এবারই প্রথম নয়।
ইতিহাসবিদরা বলেন, পুরনো ঢাকার এই চকবাজারের সূচনা হয়েছিলো মুঘল আমলে। আর তখন থেকেই ব্যবসার গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র এই চকবাজার। ব্যবসার পাশাপাশি এই চকবাজারে আছে হোসেনি দালান, বড় কাটরা, ছোটো কাটড়া কিংবা শাহী মসজিদের মতো নানা ধরণের স্থাপত্যকর্ম। তবে এই চারশো বছর পরে এসে ঢাকা অনেক বিস্তৃত হয়েছে সব দিকেই। কিন্তু ব্যবসায়িক বিবেচনায় গুরুত্ব হারায়নি চকবাজার।মুঘলরা আসার পর থেকে চকবাজার গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে সতের শতকে। পরে বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবেই দাঁড়িয়ে যায়।