সুদীপা ২২ বছরেই ৩০০ বাচ্চার গ্যাং মা
অমিত চৌধুরী
পুষ্পপ্রভাত পত্রিকা
প্রকাশিত : ১০:০৫ এএম, ১৯ জানুয়ারি ২০২৫ রোববার
স্কুলের পড়াশোনাটা তখনও সম্পূর্ণ হয়নি। একাদশ শ্রেণীতে পাঠরত ১৭ বছরের মেয়েটি সেদিন স্কুল ছুটির পর বাড়ি ফেরার পথে স্টেশনে বসে টিফিন করছিল | ঠিক সেই সময় একটি বাচ্চা ছেলে তার কাছে ভিক্ষা চাইতে আসে | বাচ্চা ছেলেটিকে ভিক্ষা চাইতে দেখে সেদিনের সেই মেয়েটি মনে মনে খুব কষ্ট পেয়েছিল | তবু তার কষ্টটা প্রকাশ না করে সেদিন সে বাচ্চাটিকে কোনরকম টাকা পয়সা না দিয়ে তার টিফিন খাবার তার সাথে ভাগ করে খেয়েছিল এবং হাতে কিছু বিস্কুট ও চকলেট তুলে দিয়েছিল | চকলেট ও বিস্কুট পেয়ে বাচ্চাটি এতটাই খুশি হয়েছিল যা দেখে স্কুল পড়ুয়া মেয়েটি সেদিনই মনে মনে ঠিক করে নিয়েছিল আর যাই হোক সে আর তাকে ভিক্ষা করতে দেবে না | এই ভাবনা যেন বেশ কিছুদিন তাকে রাতে ঠিক মতো ঘুমোতে দেয়নি | সেদিনের রাতের ঘুম উড়িয়ে দেওয়া , মনের ভেতর নতুন কিছু করার কৌতুহল অদম্য জেদ ও তার প্রবল ইচ্ছাশক্তিতেই আজ মেয়েটি ৩০০ বাচ্চা গ্যাং এর মা হয়ে উঠেছে | নিজের হাতে তৈরী করেছে একটি পাঠশালা যেখানে প্রতিনিয়ত ৩০০জন বাচ্চা পড়াশোনা করছে |
নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগর শহরের বাসিন্দা সুদীপা চ্যাটার্জি বর্তমান এম. এ বাংলা বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্রী | বাবা সুব্রত চ্যাটার্জী ও মা রুপা চ্যাটার্জির মেয়ের গল্পকথা রূপকথার গল্পের মতো মনে হলেও সত্যিতেই আজ সে কৃষ্ণনগরের গর্ব |
মাত্র ২২ বছর বয়সেই সুদীপা এখন ৩০০ জন বাচ্চার মা | চায়ের আড্ডায় নিজেই শেয়ার করলেন সেই কথা ( তার মতে ).....
স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে স্টেশনের সেই দিনের ভিক্ষুক ভাইটির কথা ( দিদি কিছু খাবো টাকা দাও ) সত্যিতেই তাকে অন্তর থেকে নাড়িয়ে দিয়েছিল | সেদিনের পুরো বিষয়টি সে তার মায়ের সাথে শেয়ার করেছিল এবং জানিয়েছিল বাচ্চাটির পাশে দাঁড়ানোর কথা এবং বলেছিল যতই যা হোক না কেন ছেলেটিকে আর ভিক্ষা করতে দিবে না | সুদীপা বলেন, প্রথমে মা আমার কথাগুলো শুনে অবাক হলেও পরে মায়ের সম্পূর্ণ সহযোগিতা ও সমর্থন পেয়ে সেই সমস্ত অসহায় ভিক্ষুক বাচ্চাদের খোঁজ করি ও তাদের দেখাশোনার কাজ শুরু করি প্রথমদিকে ১৮ - ২০ জন বাচ্চাদের নিয়েই আমাদের পথ চলা শুরু হয় | পরবর্তীতে পিছিয়ে পড়া আরো কিছু অসহায় বাচ্চাদের মধ্যে ভাতজাংলা, কালিপুর, নিচের পাড়া, রাওতারা আদিবাসী সোনা ইটভাটার প্রায় ৩০০ জনকে সাথে নিয়ে আমাদের কর্মসূচির তালিকা করে নিজেদের খরচেই তাদের দেখাশোনা, খাওয়াদাওয়া, জামাকাপড়, ওষুধপত্র, দেওয়ার পাশাপাশি তাদের শেখার ইচ্ছা ও জানার কৌতূহল দেখতে পেয়ে নিজেরাই তাদের পড়াশোনা করানোর দায়িত্বভার তুলে নিই |
তার কথায় বাচ্চাদের পড়াশোনা করানোর জন্য প্রথমদিকে শুরুতে একটি গাছের নিচে বসে প্রতিনিয়ত সময় করে তাদের পড়ানো শুরু হয় | তারপর ধীরে ধীরে বই, খাতা, কলম এবং আরো কিছু শিক্ষা সামগ্রী তাদের হাতে তুলে দেওয়া হয় | এভাবে বেশ কিছু দিন ধরে চলতে থাকে যদিও প্রথম প্রথম ওদের মায়েরা আপত্তি জানালেও একটা সময় তারাই তাদের বাচ্চাদের পড়ানোর জন্য নিয়ে আসতে থাকে এবং যতদিন যেতে থাকে দায়িত্ব বাড়তে থাকে | প্রতিনিয়ত একজন দুজন করে বাচ্চা আসতে থাকে আর এভাবেই গাছের নিচে বসে পড়ানোর জায়গাটা ধীরে ধীরে ছোট্ট একটি পাঠশালার রূপ নেই |
পরিশ্রম ও ধৈর্যের মধ্যে দিয়ে অনেক সমস্যা ও বাধা কাটিয়ে ধীরে ধীরে এই পাঠশালাটি তৈরী হয় তাই হয়তো এই পাঠশালাটির নাম "একটু ঢিলেমি" | তবে এই পাঠশালাটি এলাকায় সুদীপার পাঠশালা নামেই বেশি পরিচিত | মা রুপা চ্যাটার্জির কথায় মেয়ের জেদ ও ইচ্ছাশক্তি এবং পাশাপাশি সকলের আশীর্বাদ ও সহযোগিতা তাকে আজ এই জায়গায় পৌঁছে দিয়েছে। আমি মেয়ের জন্য আজ গর্বিত এবং সত্যিতেই ও আমার কাছে গড গিফ্টেড |
শিশু বিদ্যালয়গুলিতে যেভাবে শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষায় একটি শিশুর আজীবন শেখার যাত্রার ভিত্তি তৈরি হয়, মনের মধ্যে নতুন কিছু জানার বা শেখার কৌতুহল সমালোচনামূলক চিন্তা ভাবনা এবং জ্ঞানের প্রতি ভালোবাসা বৃদ্ধি করায় ঠিক সেইভাবেই সুদীপাও প্রথমদিন থেকে আজও প্রতিনিয়ত তার পাঠশালার বেশিরভাগ হত দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে আসা এক একজন বাচ্চাগুলোকে শিক্ষা দিয়ে চলেছে | পড়াশোনার পাশাপাশি যে সমস্ত বাচ্চাদের আগ্রহ নাচ - গান ছবি আঁকা ইত্যাদির উপর মনোযোগ থাকে তাদের কে তিনি নিজেই শেখান আর এই কাজে প্রথম দিন থেকেই তার মা পাশে থেকে সাহায্য ও গাইড করে এসেছেন | সুদীপার এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে অনেকেই এখন এই এলাকায় আসে এবং তাদের নিজেদের সাধ্যমতো তার বাচ্চাদের সাথে আনন্দ খুশি ভাগ করে নেয় | ২০২১ সালে ৪০ জনকে নিয়ে শুরু "একটু ঢিলেমি" পাঠশালায় বর্তমানে ৩০০ জন বাচ্চা পড়াশোনা করে |
৩০০ জন বাচ্চার পড়াশোনা করানোর পাশাপাশি তাদের খাওয়াদাওয়া, ওষুধপত্র , জামাকাপড় দেওয়া ও দেখাশোনার দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে মাত্র ২২ বছর বয়সে সুদীপা সকলের কাছেই এখন ৩০০ জন বাচ্চার মা হিসেবেই বেশি পরিচিত |
কথাগুলো রুপকথার গল্পের মতো মনে হলেও তার অদম্য জেদ, ইচ্ছাশক্তি ও বাচ্চাদের প্রতি অফুরান ভালোবাসা মানবতার প্রতীক সুদীপা চ্যাটার্জী এবং আড়ালে লুকিয়ে থাকা এমন অনেক সুদীপার গল্প হয়তো আমাদের অজানা রয়েছে যারা প্রতিনিয়ত সমাজের পিছিয়ে পড়া সাধারণ অসহায় মানুষদের জন্য লড়াই করে চলেছেন তাদের প্রত্যেককেই আমাদের কুর্নিশ জানায় |