জাতি সত্তা, ভাষা সত্তা, ধর্মনিরপেক্ষতা ও ডঃ শহীদুল্লাহ
খগেন্দ্রনাথ অধিকারী
পুষ্পপ্রভাত পত্রিকা
প্রকাশিত : ০৫:৫২ পিএম, ২০ জুলাই ২০২৪ শনিবার
জাতি সত্তা, ভাষা সত্তা, ধর্মনিরপেক্ষতা ও ডঃ শহীদুল্লাহ
খগেন্দ্রনাথ অধিকারী
জাতি সত্তা, ভাষা সত্তা ও ধর্ম নিরপেক্ষতা, এই তিনটি বিষয় নিয়ে গোটা বিশ্ব আজ তোলপাড়। তোলপাড় আমাদের এই ভারতীয় উপমহাদেশ। সমস্ত মৌলবাদীরা কি ধর্মীয় মৌলবাদী, কি ভাষাগত মৌলবাদী, কি জাতিগত মৌলবাদী, সমস্ত মৌলবাদী শক্তিগুলিই আজ দেশে দেশে সভ্যতা, সংস্কৃতি ও মানবতার সামনে এক গভীর চ্যালেঞ্জ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছে। এই প্রেক্ষাপটে এই উপমহাদেশে তথা অবিভক্ত ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতি সত্তাগত স্বাতন্ত্র্য ও ভাষাগত স্বাধিকারের আপোষহীন সংগ্রামী বরেণ্য ভাষাতত্ত্ববিদ ডঃ শহীদুল্লাহকে স্মরণ করতে চাই। ইংরেজ শাসনাধীনে ১৮৮৫ সালের ১০ই জুলাই তিনি অবিভক্ত বাংলার অধুনা পশ্চিমবাংলার পেয়ারা গ্রামে জন্মগ্রহন করেন এবং ১৯৬৯ সালের ১৩ই জুলাই তৎকালীন পূর্ব্বপাকিস্থানের ঢাকায় মৃত্যু বরণ করেন। শৈশব থেকেই ডঃ শহীদুল্লাহ ছিলেন একজন সংস্কারমুক্ত মানুষ। এবং বলা যায় যে তিনি ছিলেন চিন্তায় ও ভাবনায় গতানুগতিকতা বিরোধী একজন বিপ্লবী চেনতার অনন্য সাধারণ মানুষ। সাধারণের মধ্যে আজও প্রকাশ্যে--অপ্রকাশ্যে এই ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে যে সংস্কৃত হোল বেদ--বেদান্তের ভাষা, দেব-ভাষা, হিন্দুদের ভাষা। আর আরবী হোল কোরাণ ও হাদিসের ভাষা, ইসলামের ভাষা। স্বভাবতঃই মুসলিমরা পড়বে আরবী, হিন্দুরা পড়বে সংস্কৃত। ডঃ শহীদুল্লাহ এই গতানুগতিক ভ্রান্ত ধারণাকে দুপায়ে দলে পিষে, অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ অবস্থান লেন এই ক্ষেত্রে। তাঁর বক্তব্য ছিল যে ভাষা কোন বিশেষ ধর্মের বা কোন জাতির বিষয় নয়। ভাষা হোল বেগবতী নদীর ধারার মত। ধর্ম দিয়ে বা জাতপাত দিয়ে তাকে বাঁধা যায় না। এই বাঁধার চিন্তাটাই হোল নির্বোধের হাস্যকর প্রয়াস মাত্র। এই অবস্থান থেকে ডঃ শহীদুল্লাহ সংস্কৃত ভাষা নেন স্নাতক ও স্নাতকোত্তর স্তরে। মৌলবাদী হিন্দু ও মৌলবাদী মুসলিমরা এতে রে রে করে ওঠে। একদিকে উলেমাপন্থীরা অর্থাৎ মুসলিম মৌলবাদীরা বলতে থাকেন--"মুসলিম ঘরের একটি মেধাবী-উজ্জ্বল সন্তান, সে কোথায় আরবি নিয়ে পড়বে এবং বড় হয়ে ইসলামী ভাবধারা ও ইসলামী সংস্কৃতি চর্চায় মূল্যবান অবদান রাখবে, তা না করে সে কিনা বেদ বেদান্ত উপনিষদের ভাষার দিকে, হিন্দুদের ভাষার দিকে ঝুঁকেছে ও ঝুঁকছে। কোন মোমিন ভাই কি এটা মানতে পারে?
অন্যদিকে, গোঁড়া হিন্দুরা, বিশেষ করে সংস্কৃত পণ্ডিতরা বলতে থাকেন--সংস্কৃত পড়বে হিন্দুরা। তারা এটা পড়ে হিন্দু সংস্কৃতিকে জানবে ও বুঝবে। তা না করে কিনা মুসলিম ঘরের ছেলেরা সংস্কৃত শিখবে! এ অসহনীয়। এ মানা যায় না। হিন্দু ধর্মের তথা দেবভাষা সংস্কৃতের পবিত্রতা এতে বিনষ্ট হবে। শহীদুল্লাহর এই স্পর্ধাকে রুখতেই হবে।
শেষ পর্যন্ত, কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখার্জী আসরে নামেন। হিন্দু মৌলবাদী ও মুসলিম মৌলবাদী উভয় মৌলবাদী শক্তিকে ক্ষুরধারভাষায় তিনি আক্রমণ করেন এবং বলেন যে কোন ভাষা কোন বিশেষ ধর্মীয় গোষ্ঠীর লোকদের পৈত্রিক সম্পত্তি নয়। সব ভাষার দ্বার সবার কাছে উন্মুক্ত। যে কেউ যে কোন ভাষা নিয়ে চর্চা করতে পারে--এটা তার জন্মগত অধিকার। ধর্মের দোহাই পেড়ে কেউই এক্ষেত্রে কারোর আগ্রহকে দমিত করতে পারে না। দমন করার বা বাধা দেবার কোন চেষ্টা হোল একটি দানবীয় বর্ব্বরতা। এইভাবে স্যার আশুতোষ মুখার্জীর বলিষ্ঠ হস্তক্ষেপে ছাত্র শহীদুল্লাহ সংস্কৃত নিয়ে পড়ার সুযোগ পান। সাম্প্রদায়িকতাবাদী মৌলবাদী হিন্দু ও মুসলিমরা লেজ গোটাতে বাধ্য হয়।
ধর্ম নিরপেক্ষতার পথে তথা ভাষাগত প্রশ্ন নিয়ে তরুণ শহীদুল্লাহর এইভাবে চলা শুরু। তিনি বাংলা, উর্দূ, আরবি, সংস্কৃত, ইংরাজী সহ ২৪টি ভাষা রপ্ত করেছিলেন। এর মধ্যে ১৬টি ভাষায় তিনি ছিলেন ভীষণ তুখোড়। সাবলীল ভাবে লিখতে, পড়তে, কইতে পারতেন--তাঁর এই ভাষাগত বহুমুখীতা তাঁকে সমস্ত সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে তুলেছিল। তিনি ছিলেন এক সাত্ত্বিক সুন্নী মুসলিম। কিন্তু, কোন ধর্মীয় সংকীর্ণতা তাঁর মনটাকে কলুষিত করতে পারেনি। শিয়া, সুন্নী, হিন্দু, মুসলিম, খৃশ্চান, সকল ধর্মের সকল মতের মানুষের প্রতি তিনি ছিলেন শ্রাদ্ধাশীল। অন্যভাবে বলতে গেলে বলা চলা যে বিবিধ ভাষার চর্চা তাঁকে একজন উদার আন্তর্জাতিকতাবাদী তথা বহুত্ববাদী মানুষে পরিণত করেছিল।
পরাধীন ভারতবর্ষে জন্মে মাতৃভূমির মুক্তির জন্য তাঁর যে দায়, তা তিনি অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন। আমরা আগেই উল্লেখ করেছি যে মুসলিম মৌলবাদী উলেমা ও হিন্দু মৌলবাদী পণ্ডিতদের সমস্ত বাধাকে উপেক্ষা করে স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের অকুতোভয় হস্তক্ষেপে তিনি কিভাবে সংস্কৃত নিয়ে উচ্চশিক্ষার সুযোগ পেয়েছিলেন। এই লড়াই একদিকে তাঁর ধর্মনিরপেক্ষতার ভিতকে আরো শক্তপোক্ত করেছিল। অন্যদিকে স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় সম্পর্কে তাঁর শ্রদ্ধা গভীরভাবে বেড়ে গিয়েছিল। তবে একটি বিষয় তাঁকে আমরণ পীড়া দিয়েছে তা হোল এই যে স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের মত একজন আপোষহীন ধর্মনিরপেক্ষ মানুষের সন্তান হলেন শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, যিনি ছিলেন সাম্প্রদায়িক মুসলিম লীগের প্রতিদ্বন্দ্বী সাম্প্রদায়িক হিন্দু মহাসভার নেতা। ডঃ শহীদুল্লাহ মনে করতেন যে এই দুই অশুভ শক্তির দ্বন্দ্ব বিবেকানন্দ--রবীন্দ্রনাথ--নজরুলের বাংলাকে দ্বিখণ্ডিত করেছে।
স্মরণ রাখা দরকার যে একজন ধর্মনিরপেক্ষ ও বহুত্ববাদী ভাবনার ভাষাবিদ হিসাবে তাঁর সকল ধর্ম ও সকল ভাষার প্রতি সম মর্যাদা বোধ ছিল। কিন্তু, এতদৃসত্ত্বেও তিনি জাতি সত্তার প্রশ্নে ছিলেন আপোষহীন। ধর্মের ভিত্তিতে জাতপাত বিভাজনকে তিনি ধিক্কার দিয়েছেন। এই জন্যেই তিনি জিন্না ও ইকবালের সঙ্গে সহমত হতে পারেননি। তিনি তাই মুসলিম লীগে না গিয়ে জাতীয় কংগ্রেসে যোগ দেন। তাঁর দৃষ্টিতে জাতিসত্তা চিহ্নিত করার মানদণ্ড মোটেও ধর্ম নয়, সেটা হোল ভাষা ও সংস্কৃতি। তাই তিনি বলতেন আমরা হিন্দু হই, মুসলিমই হই, যাই হই না কেন, সবার আগে আমরা বাঙালী। এই বাঙালী জাতিসত্তার প্রশ্নে তিনি ছিলেন লৌহদৃঢ়। তিনি ছিলেন এর অতন্ত্র প্রহরী।
অন্যভাবে বলতে গেলে বলা চলে যে ডঃ শহীদুল্লাহ মোটেও উগ্র বাঙালীয়ানার প্রবক্তা ছিলেন না। তিনি সব ভাষার প্রতি ছিলেন সমানভাবে শ্রদ্ধাশীল। কিন্তু, এই শ্রদ্ধা জানাতে গিয়েও তিনি সব সময় মনে রাখতেন ও অন্যকে মনে করিয়ে দিতেন যে তিনি একজন বাঙালী, বাংলা তাঁর মাতৃভাষা এবং বিবেকানন্দ--রবীন্দ্রনাথ--নজরুলের আদর্শপুষ্ঠ বাঙালী সংস্কৃতির তিনি একজন অন্যতম ধারক ও বাহক। তাই পরাধীন ভারতবর্ষে রাষ্ট্র ভাষার প্রশ্নে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের বিতর্কে যুক্তি ও আবেগ উভয় দিয়েই বোঝানোর চেষ্টা করেন যে উর্দূ বা হিন্দী অবশ্যই সমৃদ্ধ ভাষা। কিন্তু বাংলা ভাষার সঙ্গে সমৃদ্ধির কষ্টিপাথরের বিচারে এই দুই ভাষার স্থান অনেক অনেক পরে। জিন্না ও ইকবালকে তিনি ভাষার বিবর্তনের তথ্য দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করেন যে জন্ম ও সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে উর্দূ ও হিন্দী বাংলার কাছে বহুগুণে ঋণী। কাজেই উর্দূ বা হিন্দী নয় বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করলে ইতিহাসের সঙ্গে সুবিচার করা হবে।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ, গান্ধীজী, ও সীমান্ত গান্ধী খান আব্দুল গফুর খান জাতীয় কংগ্রেস বনাম মুসলিম লীগের রাষ্ট্র ভাষাগত বিতর্কে ডঃ শহীদুল্লার অবস্থানকেই সমর্থন করেছিলেন। গান্ধীজী, সীমান্ত গান্ধী, শরৎচন্দ্র বসু ও কমিউনিস্ট নেতা সোমনাথ লাহিড়ী প্রমুখদের তীব্র বিরোধীতা সত্ত্বেও যখন দেশ বিভাগ অনিবার্য হয়ে উঠলো, তখন ইকবালের দেওয়া পাকিস্থান শব্দটিতে তীব্র আপত্তি জানিয়ে ডঃ শহীদুল্লাই বলেন যে খণ্ডিত বাংলার পূর্ব্ব অংশকে পূর্ব্ব পাকিস্থান না বলে তাকে পূর্ব্ববাংলা নামকরণ করা হোক। কিন্তু, উগ্র ভাষাগত মৌলবাদীরা তাঁর এই প্রস্তাব মানেননি। ১৯৪৮ সালে তিনি ঢাকাতে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত প্রমুখদের সঙ্গে মিলিত হয়ে একটি সংগঠন তৈরী করেন যার লক্ষ্য হয় পূর্ব্ব পাকিস্থান নামকে পরিবর্তন করে পূর্ব্ববাংলা রাখা এবং বাংলা ভাষা ও বাঙালী সংস্কৃতির অস্তিত্বকে রক্ষা করা।
পাকিস্থান কর্তৃপক্ষ ডঃ শহীদুল্লাকে পাকিস্থান উর্দূ একাডেমির সভ্য করে। সেখানেও তিনি বাংলা, উর্দূ, বেলুচি, পাঞ্জাবী সহ বিভিন্ন ছোট ছোট "Dialects" বা উপভাষা ও সংস্কৃতি সমূহের সম মর্যাদা ও সমবিকাশের কথা বলেন। কিন্তু পাক কর্তৃপক্ষ তাঁর সে কথায় কর্ণপাত করেননি। সব চাইতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হোল এই যে অবিভক্ত পাকিস্থানে জনসংখ্যার সিংহভাগই বাংলায় কথা বলতেন। স্বভাবতঃই বাংলাই অবিভক্ত পাকিস্থানের রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিৎ বলেই অনেকের মত ডঃ শহীদুল্লাহও মনে করতেন। কিন্তু পাক শাসক গোষ্ঠী সে কথায় কোন গুরুত্বই দেননি--তার পরিণতি আমাদের সকলেরই জানা।
মোট কথা, জাতি সত্তা, ভাষা সত্তা ও ধর্ম নিরপেক্ষতার প্রশ্ন নিয়ে উপমহাদেশীয় লড়াই বা বিশ্ব জোড়া লড়াই দীর্ঘদিনের এবং সেই লড়াইয়ে নমস্য একাধিক নামের মধ্যে ডঃ শহীদুল্লাহও একটি সম্মানিত ও সর্ব্বজন শ্রদ্ধেয় নাম। সারা পৃথিবীতে, বিশেষ করে ভারত, পাকিস্থান ও বাংলাদেশে এই তিনটি বিষয়ই আজ বিপন্ন। বিশেষ করে আমাদের দেশে, অশোক, আকবর, দারাশিকো, রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের দেশে হিন্দু ও মুসলিম উভয় মৌলবাদ, এবং উগ্র হিন্দী আধিপত্যবাদ আমাদের দেশের ধর্মনিরপেক্ষতা, ছোট বড় সকল জনগোষ্ঠীর জাত সত্তা ও ভাষাগত সত্তাকে বিপন্ন করছে। এর বিরুদ্ধে জাতি ধর্মনির্বিশেষে সকল শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষকে ঐক্যবদ্ধভাবে লড়তে হবে এবং ধর্মনিরপেক্ষতা, প্রত্যেক জনগোষ্ঠীর জাতি সত্তা ও ভাষাগত সত্তাকে রক্ষা করতে হবে, এটাই হোল ডঃ শহীদুল্লাহর প্রয়াণ দিবসে তথা প্রয়াণ পক্ষে সময়ের দাবী।
লেখক পরিচিতি
অধ্যাপক খগেন্দ্রনাথ অধিকারী রাষ্ট্রীয় বিদ্যাসরস্বতী পুরস্কার ও এশিয়া প্যাসিফিক পুরস্কার সহ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বহু পুরস্কার প্রাপ্ত একজন খ্যাতনামা শিক্ষাবিদ। ইনি কোলকাতার সাউথ সিটি (দিবা) কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ।
ঠিকানা-শরনিয়ার বাগান
পোষ্ট-টাকী, পিন-৭৪৩৪২৯
পশ্চিমবঙ্গ, ভারত