রোববার   ২৪ নভেম্বর ২০২৪   অগ্রাহায়ণ ১০ ১৪৩১   ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মাশরাফি যুগের ১৭ বছর পূর্তি আজ

রিয়াজুল ইসলাম শুভ

দৈনিক জাগরণ

প্রকাশিত : ১১:৩০ এএম, ৮ নভেম্বর ২০১৮ বৃহস্পতিবার

২০০১ সালের নভেম্বরে জিম্বাবুয়ে বাংলাদেশে সিরিজ খেলতে এলো। এই সিরিজের আগে এ দলের হয়ে ভারত সফর করেছিল অনূর্ধ্ব-১৭ দলের হয়ে চমক দেখানো এক ফাস্ট বোলার। তাকে দলে নিতে ক্রিকেট আলোচকরা রীতিমতো ফেনা তুলে ফেলেছিল। যদিও এত অল্প বয়সী একজনকে এত দ্রুত টেস্ট আঙ্গিনায় নামানো ঠিক হবে কিনা- তা নিয়ে বোর্ড কর্তাদের মধ্যেও ছিল বিভক্তি। 

তৎকালীন নির্বাচক কমিটির প্রধান মাইনুল হক ২০০১ সালের জুন মাসে কিংবদন্তী ক্যারিবীয় পেস বোলার অ্যান্ডি রবার্টসের জমা দেয়া বিকেএসপিতে ২ সপ্তাহের ক্যাম্পের রিপোর্ট সামনে আনলেন। তাই সেই তরুণ টগবগে যুবকের অভিষেকের সিদ্ধান্ত সবাই মেনে নিলো।

কি ছিল সেই রিপোর্টে? অ্যান্ডি রবার্টস বাংলাদেশ ছাড়ার আগে সাংবাদিকদের নাম উচ্চারণ না করেই সেই ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন- 'আমি বলতে চাই, আসলে একটা ছেলেকে ১৮-১৯ বছর বয়সে কি টেস্ট খেলিয়ে দেয়া উচিত? বিশেষ করে তার যদি প্রথম শ্রেণীর অভিজ্ঞতাই না থাকে?'

অ্যান্ডি রবার্টস বলতে থাকলেন– 'আমি সাধারণ ক্ষেত্রে এমন ফাস্ট বোলারদের খেলানোর পক্ষে নই। তবে বিশেষ কিছু ক্ষেত্র পৃথিবীতে তৈরি হতে পারে। একজন বোলার যদি চরম ব্যতিক্রমী প্রতিভাধর হয় এবং দেশটির বাকিদের চেয়ে অনেক এগিয়ে থাকে, তাকে এমন ক্ষেত্রে কোন অভিজ্ঞতা ছাড়াই অল্প বয়সে টেস্ট খেলানো যেতে পারে।'

৮ নভেম্বর, ২০০১। চিত্রা নদীর পাড়ে দুরন্ত দুষ্টুমিতে ভরা এক কিশোরের মাথায় উঠে গেল টেস্ট ক্যাপ। ক্যাপ পরিয়ে দিলেন তৎকালীন নির্বাচক কমিটির প্রধান মাইনুল হক। ক্যাপ নম্বর ছিল ১৯ অর্থাৎ টেস্টে ১৯তম খেলোয়াড় হিসেবে তার অভিষেক হয়েছিল। সাদা পোশাকে সবুজ টুপি পরা ছেলেটি আজকের ক্রিকেটের মহানায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা।

মাশরাফি একটি যুগের নাম, একজন যোদ্ধার নাম, এক অনুপ্রেরণার নাম, বারবার ফিরে আসা অতিমানবের নাম যাকে নিয়ে উপাখ্যান লেখা শেষ হবার নয়। বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের কিংবদন্তী নিয়ে প্রখ্যাত ক্রীড়া সাংবাদিক দেবব্রত মুখোপাধ্যায় বলেছেন- 'ক্রিকেটার কেবল নয়, কোন জাতির ইতিহাসে এমন মানুষই আসে শতবর্ষের আরাধনায়। মাশরাফি হলো গ্রিক ট্র্যাজেডি আর মহাকাব্য। এমন মহাকাব্যকে ধরতে পারতেন মহাকবি হোমার আর মহাঋষি বেদব্যাস।'

আসলেই তাই। ট্র্যাজেডি আর রোমান্টিকতা দুইটাই তার জীবনে বহুবার এসেছে। হাঁটুর ইনজুরিতে বারবার দল থেকে ছিটকে পড়া,৭ বার অপারেশন করেও বারবার ফিরে আসা এ যেন মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠের বারবার অদল-বদল! ২০১১ বিশ্বকাপে দলে না থাকায় কান্নায় ভেঙ্গে পড়া, প্রথম সন্তান হুমায়রার জন্মের সময় প্রিয়তমা স্ত্রীর মৃত্যুর কাছাকাছি চলে যাওয়া, পুত্র সাহেলের ভয়ানক অসুস্থ হওয়ার পরেও দেশ ও দলের প্রতি আনুগত্যের জায়গা থেকে ২০১৫ বিশ্বকাপ চলাকালে দেশে না আসা আরও অনেক বিষয় আছে যা তাকে হিমালয় ছাড়িয়ে যাওয়া ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছে।

আরেক ক্রীড়া সাংবাদিক মেহেরিনা কামাল মুন বলেছিলেন– 'খেলোয়াড় মাশরাফি নিয়ে কথা বলা যায়, কিন্তু ব্যক্তি মাশরাফির কোন তল খুঁজে পাবেন না!' 

একজন মানুষ কতটা আন্তরিক, বন্ধুভাবাপন্ন, সাধারণ, মিশুক, বিনয়ী, দানশীল, দেশপ্রেমিক হতে পারে তা মাশরাফিকে অবলোকন করলেই বোঝা যায়। নিজ এলাকার পরিচিত অনেককে তার করা সাহায্য এখনো সবাই কৃতজ্ঞতার সাথে স্বীকার করেন।

অনেক স্মরণীয় ম্যাচের জয়ের নায়ক মাশরাফি। ২০০৪ সালের ভারত বধ, ২০০৭ বিশ্বকাপে আবারো ভারতকে হারিয়ে তাদের বিশ্বকাপ মিশন শেষ করা, ২০১০ সালে প্রথম ইংল্যান্ডকে ওয়ানডেতে হারানো, এমন অনেক উদাহরণ দেয়া যাবে। তবে স্বল্প পরিসরের এই লেখায় বিশেষভাবে এই তিন ম্যাচ উল্লেখের কারণ হলো তখন জয়ের অভ্যাসটা টাইগারদের ঠিক গড়ে ওঠেনি, একেকটা জয় পেতে তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষা করতে হতো। 

২০১৫ সালের বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনালে খেলা, তারপর ঘরের মাঠে পাকিস্তান, ভারত এবং দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দলের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজ জেতা, সর্বশেষ এশিয়া কাপে মাশরাফির নেতৃত্বে রানার্সআপ হয়ে আসাতো স্বাভাবিকভাবেই তাকে অনন্য এক উচ্চতায় নিয়ে গেছে।

ক্যাপ্টেন ফ্যান্টাসটিকের হাতে এখনো অধিনায়ক হিসেবে টুর্নামেন্টের শিরোপা জয়ের ট্রফি ওঠেনি। কিন্তু একটা ট্রফি দিয়ে কি মাশরাফিকে পরিমাপ করা যায়! তিনি নিজেই তো বলেছেন একটা ট্রফি দিয়ে কখনো আমাকে পরিমাপ করা যাবে না। আর আমার জন্য নয়, ট্রফি জেতা দরকার দেশের জন্য। 

অধিনায়ক মাশরাফি শুধু নেতা নয়, একজন বড় ভাই, একজন মেন্টর, একজন দিক নির্দেশনা প্রদানকারী, একজন বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী সর্বোপরি সফল দলে পরিণত করা একই সূতায় গাঁথা একটি দলের বটবৃক্ষ, যার ছায়াতল পাওয়া বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের আজন্ম সৌভাগ্য!

ক্রিকেট যতই পরিসংখ্যান ও সংখ্যার বাহারে পরিপূর্ণ হোক না কেন, এইসব দিয়ে একজন মাশরাফিকে মূল্যায়ন করা মানে ক্রিকেট মস্তিষ্ক না থাকা। দলে তার ভূমিকা ও অবদানের কাছে তা তুচ্ছ। যদিও তা বেশ মজবুত তবে একজন মাশরাফিকে বোঝাতে তা সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ।

একজন মাশরাফি পেতে তপস্যা করতে হয়। আর আমরা ভাগ্যগুণে পেয়েছি তাকে আমাদের দেশে। অবশ্যই এটা সৃষ্টিকর্তার নিয়ামত। তবে নিয়ামত চিনতে ও ধরে রাখতে জানতে হয়। এই ধরে রাখা ও খাঁটি মানুষ হিসেবে মাশরাফির গড়ে উঠার ব্যাপারে তার পরিবারের অসামান্য ভূমিকা আছে যার জন্য জাতি হিসাবে সেই পরিবারের কাছে কোটি মানুষের ঋণ আছে বলা বাহুল্য।

আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, টিমমেট, কোচিং স্টাফ সবার অবদান রয়েছে একজন মাশরাফিকে পাওয়ার জন্য। সবার কথা একটি মাত্র লিখনিতে উল্লেখ করা মুশকিল। হয়তো এই দীর্ঘ লেখা অনেকের বিরক্তির কারণ হবে কিন্তু তিনজন মানুষের কথা পরিশেষে উল্লেখ না করলে রীতিমত পাপ হবে আমার। প্রথমজন অবশ্যই আন্ডি রবার্টস। যার কথা অনেকাংশেই উল্লেখ করা আছে। দ্বিতীয়জন অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী ইকরাম বাবু ভাই, যার বাসায় বারবার মাশরাফিকে উঠতে হয়েছে আর চিকিৎসা করাতে হয়েছে সেখানে অবস্থান করে। তৃতীয়জন ড. ডেভিড ইয়াং। যার হাতের ছোঁয়ায় আমাদের মাশরাফি বারবার মাঠে ফিরে এসে এখনো দেখিয়ে যাচ্ছেন তার জাদু। 

দীর্ঘ এই ক্যারিয়ারে এসেছে নানা প্রতিকূলতা। তারপরেও থেমে থাকেননি অদম্য আর অনবদ্য মাশরাফি বিন মুর্তজা। আজ ১৭ বছর পূর্ণ হওয়া এই পথচলায় তোমায় সালাম ও অভিবাদন!  

 

আরএস