শনিবার   ১৬ নভেম্বর ২০২৪   অগ্রাহায়ণ ২ ১৪৩১   ১৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

আমার মাটির কোলাজ

বেদশ্রুতি মুখার্জী

পুষ্পপ্রভাত পত্রিকা

প্রকাশিত : ১০:৫৭ এএম, ৭ জুন ২০২০ রোববার

আমার মাটির কোলাজ :-
-বেদশ্রুতি মুখার্জী

আমার মাটির পুতুল গুলো কই???
প্রতিবার পীরের মেলা থেকে বাবা নিয়ে আসত যেগুলো---
খানখান হওয়া আত্মবিশ্বাসে সেই মাটি মিশিয়ে
আবার বসতি তৈরি করব।

পায়ের মাটিটা সরে গেলে মাটিতেই মেশে মন।
খালি পায়ে মাটির স্বাদ নিতে চষে বেড়িয়েছি কলেজস্ট্রিট...
পৃষ্ঠার সিঁদ কেটে ঢুকেও মেলেনি সোনার কাঠি- 
রূপোর কাঠির মত মাটি।
প্যারালাল লাইনে আজীবন আমি আর মাটি।

প্রথম সরেছিল, যেবার বিসিএস মেইন ফেল করি,
সারা দুপুর কুলিক পাড়ে মাটি খুঁজে খুঁজে হয়রান।
সিটির পর সিটিতে সেদ্ধ করছিল আমায় 
সাইকোলজিক্যাল কুকারটা। মাটি পাইনি...

চিতার সামনে কাঁপছিলাম যেদিন আগুনহাতে,
সেদিনও মাটি সীতার মতোই পাতাল প্রবেশে।
মাটি সরে গেলে সূর্য বড় হয় জানি। 
তুমি চলে গেলেও দেখলাম ফোনটা বালি হয়ে গেল।
অথচ আমি তো খুঁজছিলাম একমুঠো মাটি।
ইনসম্যানিয়ায় মুঠি মুঠি স্লিপিং পিলস্
আর রবীন্দ্রনাথ যে কোলাজ বানায়---
মাটি তাতে উধাও দর্শক। রাত গাঢ় হলে
একটা মাটির চাদর চায় সকলেই। 
জ্বর বাড়লেও চাই মাটির হাতের আদর-
রাতে একটা বিশ্বাসী মাটির বুক-বালিশ।

ক্যাম্প 22 তে বন্দী আমি এই মাটির লোভে,
তিস্তা থেকে ভাগীরথী খুকড়ি দিয়ে খুঁড়ে খুঁড়ে 
দেখেছি একফোঁটা মাটি নেই আমার ভেতর।

                        অথচ---
আমি চিরকাল মাটির খোঁজেই মাটি হলাম।
তাই আমার বাঁধানো ফটোফ্রেমটা অন্তত হোক---
চাপ চাপ রক্তে জমাট- কান্নামাটির কোলাজ।


সনেটীয় কান্না:-
✍-বেদশ্রুতি মুখার্জী

গলার ভেতর একটা জমাট দলাপকানো জমি...
বহুকাল লাঙল পড়েনি তাতে, 
বেরিয়ে আসেনি অ্যাসিড বৃষ্টি।
চোখদুটো আটাকামা মরুভূমির শুষ্কতায় ফুটিফাটা। তার ওপর আমার কলিংবেলটায় জং পড়েছে, একাই তালা খোলার বদ অভ্যাসে,
হৃদয়ের তালাও খোলা হয়নি বহুকাল। চাবিটা কবেই সেই সুদূরের লাভলক ব্রীজে হারিয়ে গেছে। কথার অভাবে ভুলেই গেছি স্বরের কম্পন, লকডাউন মিটলে চমকে উঠব পাছে ভূতের মত।

ব্যালকনির পাতাবাহারটাও ঝাপসা ধুলোয় বহুকাল একা অসুখ ফুলগাছটার মতোই,ঠিক যেভাবে রাত বাড়লে মানুষ একা হয়।
চোখের কুঠুরিতে হারিয়ে আলপথ পেরিয়ে এখন
আল্পসে। রাত গভীর হলে রোজকার ডাক্তারি ডোস---
ভূমধ্যসাগরে ঝাঁপাবো।

 

আরেকটি খুনের গল্প :-
✍-বেদশ্রুতি মুখার্জী

পাঁচ রাত থেকে একমুহূর্তও বৃষ্টি ধরেনি...
প্রতিটি রাত যেন মহাবলী পঞ্চপাণ্ডব,
ভেতরে-বাইরে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ চলছে। 
"মা ফলেষু কদাচন"- আউড়ে ফ্রয়েডও চুপচাপ।
ক্ষয়িষ্ণু সিগারেটের মত পিষে গেছে আমার 
বহু অর্জিত নাম, স্মৃতি -সত্তা -ভবিষ্যৎ ;
জানালায় পিছলে পড়ছে আলো, শব্দ, ভাব।
একটা করুণ সুর ভেসে আসছে আমার চিতা থেকে...

কাল নাকি আমার দ্বিজত্বপ্রাপ্তি???
এই অষ্টম মহাসাগরের জল ক্রমেই গিলছে 
আলোকজন্মের চোরা মরুবালিয়াড়িটাকে।

আজীবন শুরুর আগেই চিতার কাঠ কাটি,
কালিদাসের মতোই ডালে বসে,
পার্থক্য এটুকুই--- বনবাস হয়, মেঘদূত নয়।


ছায়াপিণ্ডের মত মিশকালো আমার গল্পেরা 
বরাবরই খুব আত্মঘাতপ্রিয়।
অতিকষ্টে আমি তাদের অ্যাকিউরিয়ামে
টুকটাক প্লেটোনিক প্রেমের চার দিয়ে জোর করে জিইয়ে রেখেছিলাম। কিন্তু- আবার শ্রাদ্ধ...

ইদানিং তারা খুনী কলমের ডগায় রোজ গলা দিচ্ছে।


ন হন্যতে:-
-বেদশ্রুতি মুখার্জী

অতীত একটা ভয়ংকর কাঁটাগাছ...
চাইলেও তার বিষফল থেকে রেহাই মেলেনা।
অজান্তেই তোমার আত্মায় ভর করে-
কারোর চোখ, চুলের অশরীরী ফিনিক্স হাতছানি।

রাত বাড়তেই গভীরতর হয় মনের শহর।
অন্ধকার অলিগলি জুড়ে দৌড়তে থাকে
চিল শকুনেরা, 

          খোঁজ 
                   খোঁজ 
                             খোঁজ...

নতুন রসদ খুঁটে খুঁটে খায় অবচেতন---
খুঁড়ছে সে অবিরত, কোথাও যদি রক্তাক্ত
অতীত পাওয়া যায় একটুকরো।
কেকের মত তাড়িয়ে তাড়িয়ে বিষাদ খাওয়া যাবে।
আহা কি স্বাদ !!! বিস্বাদ বাসী বিষাদের...

আসলে ভোলা যায় না কিছুই, ভুলতে অভিনয়।
ন হন্যতে, ন হন্যমান্ শরীরে।।।
গা গুলিয়ে ওঠে তোমার আম্লিক অবচেতনের আঁশটে গন্ধে,
চমকে উঠি দূরের মন্দিরের কাঁসরে, এদিকে মনের ভেতর রাগ দীপক...


আত্মহত্যার একটু আগে :-
✍-বেদশ্রুতি মুখার্জী

নতুন কেনা ফুলিয়ার তাঁতে পুজো সেরে উঠে আয়নায়... এবার পিঁপড়ের মত খাবারের খোঁজ- রোজকার ইঁদুরদৌড়।

চুল আঁচড়াতে গিয়ে দেখি শাড়ির প্রতিটি সুতো বাড়তে বাড়তে ফাঁস হয়ে গেল। আমিও আজ পারছিনা ছাড়াতে নিজেকে, মিথ্যে অপবাদের জাল। কালুডোমের ফাঁসের চেয়েও ভয়াবহ শক্ত।

আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। গীতবিতান একটু আগে ঠাকুরঘরে ঝুলে পড়ল 'বাসাংসি জীর্ণানি' আর্তরবে। নিখুঁত ব্রুটাসের মুখ মনে করে শেষ বমিতে ভেসে যাচ্ছে আমার শাড়িটা। 

আমার চোখ বুজে আসছে, ছটফট করছি মিথ্যা টেক্সট এর কালিতে। বার্ডম্যান- মাইকেল কিটনের মতোই একটু পরেই উড়ে যাব আকাশে।
আমায় নিতে চলেও এসেছে আনুবিস।

যদি পুনর্জন্ম বলে কিছু থাকে, তোমাকে ওসাইরিস এর রাজসভায় নিতে আসব।

 

মামেকং শরণং ব্রজ :-
-বেদশ্রুতি মুখার্জী

অসহ‍্য অরিজিৎ ঘরের চারকোণে আরো বিষাদ ছড়াচ্ছে...
আমি পড়ছি ফ্রয়েড আর বুঝছি মদন তাঁতির তাঁতের মত খটখটাং মনোজগতে
ইকুইল্যাটেরাল ডাইমেনশনে জীবন আর আমি।
ম্যানহট্টান ডিসট্যান্সে জীবন আমায় ভেংচি কেটে পালায়।
আমিও জীবনের মুখে থুতু ছিটিয়ে মৃত্যুর নেলপলিশ লাগাই।

শুনছি আমার দ্বন্দ্বে ব্যাস নাকি পোড়াবেন চতুর্ভুজ চতুর্বেদ...
উনি এলে আমি কথ্থক শেখাবো ভাবছি।
কিংবা নীলাভ স্বপ্নিল চোখে সমুদ্র দেখাব,
নিদেনপক্ষে ওনার দাঁড়ি নিয়ে বিনুনি করে দোল খাবো।
দুই শব্দ-ব্রহ্মে ব্রহ্মার ঘুম উড়িয়ে- 
আমি বিকেল পর্যন্ত গড়িয়ে গড়িয়ে ঘুমাবো।

বিছানা থেকে গড়িয়ে আমি নীচে পড়ে গেলাম হোমাগ্নিতে...
আমার জহর হচ্ছে নাকি এখানে???
দুহাতে আগুন জ্বালিয়ে সব স্মৃতি খাক করব এইবার।
তারপর আমার মুখাগ্নির একমুঠো ছাই উড়িয়ে- 
মাটিতে মিশব ঈশ্বর হয়ে। 
প্রেমের অস্থি ভাসিয়ে সিজদা করব ঘৃণাকেই।

চারিদিকে এখন বারুদের গন্ধ, আর আমি তো
চিরকালই সুইসাইডিয়াল বোম্বার। 
তারপর এই অপ্রেমে কেটে যাবে দু তিন জন্ম।
        
         তারপর আবার জন্মালে ঈশ্বর হবো---
মানুষ হওয়া বড্ডো কঠিন। জাজমেন্টাল ঈশ্বরই সেফ।
আর উঠতি ছেলেমেয়েদের স্টেটাস দিয়ে যাব---
"মামেকং শরণম্ ব্রজ"...