অনাথ তপশিলি জাতি ছাত্রের কান্ডারী এক মুসলিম পরিবার
শিষ মোর্তজা
পুষ্পপ্রভাত পত্রিকা
প্রকাশিত : ১১:২৫ এএম, ২৯ মে ২০১৯ বুধবার
গোটা ভারতবর্ষের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার দেশ ও বিদেশে যখন সমালোচনার ঝড় উঠেছে, ঠিক সেই মুহূর্তে জানা গেল এক সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কথা। নিজের পিতা- মাতা সন্তানদের ছেড়ে চলে গেলেও এক মুসলিম পরিবার নিজের অন্য ছেলে মেয়েদের মতো মায়া মমতা দিয়ে আগলে রেখেছে এক অনুন্নত তপশিলি জাতির ছেলে জিতেন টুডুকে। জিতেন যখন খুব ছোট্ট শিশু তখন তার মা-বাবা তাদের ছেড়ে অন্যত্র চলে যায়। এই ছোট্ট শিশু গুলির দিকে ফিরে দেখেনি তাদের বাবা-মা আত্মীয়-স্বজন, সমাজের লোক বা প্রশাসন। এরা তিন ভাই বোন। জিতেন যখন দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়তো তখন তাকে ছেড়ে চলে যায় তার অন্যান্য ভাই বোন ও দিদা। অসহায় জিতেন না খেয়ে পড়ে থাকত রাস্তায় কিংবা কারো বারান্দায়।জিতেন এর শিক্ষক মহঃ মুসা জিতেন কে তুলে নিয়ে যায় নিজের বাড়িতে। পরিবারের সকলের সাথে আলোচনা করে জিতেন এর লেখাপড়াসহ সমস্ত দায়-দায়িত্ব তুলে নেই নিজের কাঁধে। মহম্মদ মুসা জিতেন কে তার বাড়িতে রেখে তার অন্যান্য ছেলেদের মতো স্কুল, প্রাইভেট টিউশন এর ব্যবস্থা করে। প্রাইমারি স্কুলের গণ্ডি পার করে দেওয়া হয় হাই স্কুল ও উচ্চমাধ্যমিক স্কুলে। তপশিলি উপজাতির জিতেন উর্দু নিয়ে উচ্চ মাধ্যমিকে ভালো রেজাল্ট করায় খুশি তার পালক পিতা- মাতা ও শিক্ষকগণ। ঘটনাটি ঘটেছে উত্তর দিনাজপুর জেলার গোয়ালপোখর ২ নম্বর ব্লকের গোয়ালগাঁও গ্রামে। ঘটনার বিবরণে জানা গেছে জিতেন যখন তিন বছরের শিশু তখন তার পিতা লক্ষ্মী রাম টুডু সংসার ত্যাগ করে চলে যায়। কিছুদিন পর তার মা ও তাদের ছেড়ে অন্য সংসার করে দিল্লি চলে যায়। আর তারা কোনদিন তাদের দিকে ফিরে দেখেনি। পাঁচ বছরের বড় ভাই এবং এক বছরের বোন পিংকি টুডু দিদা ফুলমনী মার্ডির নিকট কোন ভাবে কালাতিপাত করতে থাকে। তিন বছর পর যেতেন ও অমর গোয়ালগাঁও প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। জিতেন ও অমর যখন দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ে তখন তার দিদার একমাত্র শোয়ার ঘরখানি ও ভেঙে যায়। গরিবি অবস্থা ঠিক করতে না পারায় তার দিদা ও তার ভাই বোন চলে অন্যত্রে চলে গেলে ও জিতেন থেকে যায় নিজের গ্রামে। জিতেনের ইচ্ছে ছিল সে লেখা-পড়া করে বড় হবে। না খেয়ে এই ছোট্ট শিশুটি কখনো রাস্তায় কখনো কারো বারান্দায় ঝড়-বৃষ্টি উপেক্ষা করে শুয়ে থাকত। তার দিদির দেওয়া একটি নোংরা জামা পড়ে যেত ইস্কুলে। অন্যান্য ছেলে-মেয়েরা তাকে দেখে যখন হাসাহাসি করত, জিতেন দুঃখ পেত মনে। তার ও মনে সাধ জাগত সবার মত সুন্দর জামা পড়ে স্কুলে আসার। কিন্তু কি করবে, সেতো সবকিছু হারিয়ে ফেলেছে। একদিন তার শিক্ষক মোহাম্মদ মুসা তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার আর অন্যজামা নেই? জিতেন কেঁদে ফেললো। সে তার অশ্রুভরা চোখে বলল, না স্যার। আমার দিদির এটা জামা ছিল যেটা পরে সে কাজে যেত। তারা তো আর এখন নেই। শিক্ষক জামাটি পরিষ্কার করার কথা বলায় সে উত্তর দিল খাবার জোটে না সাবান পাব কোথায়। মাস্টারের মনে দয়া হল। জিতেন কে তার বাড়িতে ঠাঁই দিয়ে তার লেখাপড়ার দায়-দায়িত্ব ও গ্রহণ করল। এখন জিতেন উচ্চ মাধ্যমিকে ভালো রেজাল্ট করায় তার পালক পিতা- মাতা উভয়ে ভীষণ খুশি। জিতেন বলল সে তার শিক্ষক ও পিতা- মাতার অবদান এর কথা কোনদিন ভুলবে না। সে লেখাপড়া করে বড় হলে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সমস্ত রকম সচেতনতা মূলক প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করে সাম্প্রদায়িক বিভেদের বিরুদ্ধে লড়াই করবে। উর্দু নিয়ে অনার্স করার জন্য ইতিমধ্যে সে অনলাইনে আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন ও করেছে। খবর নিয়ে জানা গেছে ৮২ বছরের তার দিদা ফুলমনি মার্ডি পারোল গ্রামে তাঁর দূর সম্পর্কের আত্মীয় অনীল টুডুর বাড়িতে থাকে। জিতেন এর সংবাদ পেয়ে তার দিদা ও খুব খুশি।